সীমালংঘন
সীমালংঘন
0 Vote
93 View
সীমালংঘন একটি মারাত্মক বিষয়। পার্থিব জগতে মানুষের আয়ত্তাধীন ছোট-বড় যত প্রকারের বস্ত্ত রয়েছে, সমস্তই মানুষের মধ্যে বিভাজন হয়ে আছে। যেমন ভূ-পৃষ্ঠের বিশাল ভূ-খন্ড বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠী দ্বারা নির্দিষ্ট সীমারেখায় বিভক্ত হয়ে আছে। আবার বিশাল জলভাগের উপর কর্তৃত্ব রয়েছে তার নিকটতম ভূ-খন্ডের অধিবাসীদের। অনুরূপভাবে মহাশূন্যেও অধিকার প্রতিষ্ঠিত আছে সকল দেশের নিজ নিজ সীমানাভুক্ত ঊর্ধ্বদেশে, যাকে আকাশসীমা বলা হয়। এভাবে দেশের অভ্যন্তরের সম্পদও দেশবাসীর মালিকানায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। সুতরাং এজগতে মালিক বিহীন কোন বস্ত্তই নেই।
মোটকথা ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় সকল সম্পদের উপরই পৃথক পৃথকভাবে মানুষের একটা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত আছে। এখানে কেউ কারো বিষয়-সম্পত্তি, বাড়ী-ঘর, ধন-মাল ইত্যাদির উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। করলে তা হয় একান্তই অনধিকার চর্চা বা সীমালংঘন। এভাবে কোন দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরে স্থল, জল বা আকাশ পথে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারে না। হঠাৎ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ করলে সেখানে প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকে। আবার কেউ ভুলবশত করলে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এভাবে সমগ্র পৃথিবী চলছে একটা নিয়মের অধীনে। নিয়ম ভঙ্গ করার কোন উপায় নেই। নিয়মের ব্যতিক্রম হ’লে অশান্তি অনিবার্য।
বস্ত্ততঃ আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর সবকিছুর উপরে মানুষকে কর্তৃত্ব দিয়েছেন। ঈমানদার বান্দা মাত্রই সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করে এ পৃথিবীর যাবতীয় নে‘মত মহান আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি এবং সবকিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। মানুষের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হ’তে শুরু করে অভ্যন্তরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের উপরও তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা বিদ্যমান। মানুষ কেবল তাঁরই আনুগত্য করবে, তাঁর ইবাদত করবে, তাঁর দেওয়া বিধান মোতাবেক চলবে এটাই তার জন্য আবশ্যক। কিন্তু মানুষ তার চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় সবকিছু ভুলে যায়। আল্লাহর আনুগত্যের পরিবর্তে সে সীমালংঘন করে। ফলে সে শাস্তিযোগ্য হয়ে পড়ে।
পৃথিবীর বুকে মানুষ নিজ প্রতিষ্ঠিত অধিকারে পুরোপুরি শক্তিশালী। কেউ এর ব্যতিক্রম করতে চাইলে তা হয় আইনের পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোন কোন ক্ষেত্রে তা সীমালংঘনে পরিণত হয়। অতএব মানুষের উপর আল্লাহর সুপ্রতিষ্ঠিত অধিকারে কারো হস্তক্ষেপ যে কত বড় সীমালংঘন তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। আলোচ্য নিবন্ধে স্বয়ং আল্লাহর সঙ্গে ইবলীসের কতিপয় অনুসারীদের অযৌক্তিক সীমালংঘনের উদ্ধৃতি দেওয়া হ’ল।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِآيَاتِهِ إِنَّهُ لاَ يُفْلِحُ الظَّالِمُوْنَ-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে অথবা তাঁর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে তার চেয়ে বড় সীমালংঘনকারী কে ? নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারীরা সফলকাম হবে না’ (আন‘আম৬/২১)।
মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর ঘোর শত্রু। কারণ মিথ্যাবাদীরাই কেবল আল্লাহর সম্বন্ধে অপবাদ রটনা করতে সাহস পায়। এরা অনেক সময় অনুকূল পরিবেশ পেলেও মিথ্যাকেই পসন্দ করে এবং আল্লাহর বিরোধিতায় মত্ত থাকে। এদের আরও পরিচয় জানিয়ে আল্লাহ তা‘আরা বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَذَبَ عَلَى اللهِ وَكَذَّبَ بِالصِّدْقِ إِذْ جَاءَهُ أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِيْنَ-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সম্বন্ধে মিথ্যা বলে এবং তার কাছে সত্য আগমন করার পর তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে, তার চেয়ে অধিক সীমালংঘনকারী (যালিম) আর কে হবে ? অবিশ্বাসীদের বাসস্থান জাহান্নাম নয় কি?’ (যুমার ৩৯/৩২)।
একই মর্মার্থে আরো বর্ণিত হয়েছে যে,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ أَلَيْسَ فِيْ جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِيْنَ-
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে অথবা তার কাছে সত্য আসার পর তাকে প্রত্যাখ্যান করে তার চেয়ে বড় সীমালংঘনকারী কে? কাফেরের (সীমালংঘনকারীর) আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি?’ (আনকাবুত ২৯/৬৮)।
সীমালংঘনকারীদের নিরুৎসাহিত করার মহান প্রয়াসে তাদের অভিন্ন লক্ষ্যের বিভিন্ন মনোভাব ব্যক্ত করে মহান আল্লাহ বলেন,
فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِباً لِيُضِلَّ النَّاسَ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ-
‘যে ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর সম্বন্ধে মিথ্যা বলে, তার চেয়ে বড় সীমালংঘনকারী (যালিম) আর কে ? আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না’ (আন‘আম ৬/১৪৪)।
সীমালংঘন সম্পর্কে সূরা হূদেও প্রত্যাদেশ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে তার চেয়ে বড় সীমালংঘনকারী কে হ’তে পারে? এসব লোককে তাদের প্রতিপালকের সামনে হাযির করা হবে, অতঃপর সাক্ষীগণ বলতে থাকবে, এরাই ঐসব লোক, যারা তাদের পালনকর্তার বিরূদ্ধে মিথ্যা বলত। শুনে রাখ, সীমালংঘনকারীদের উপর আল্লাহর অভিশম্পাত রয়েছে। যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং তাতে বক্রতা খুঁজে বেড়ায়, তারাই পরকালকে অবিশ্বাস করে। ওরা পৃথিবীতে আল্লাহর বিধানকে ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই, তাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে। ওরা শুনতে চাইত না এবং দেখতেও পেত না। এরা সে লোক, যারা নিজেরাই নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আর এরা যা কিছু মিথ্যা মা‘বূদ সাব্যস্ত করেছিল, তা সবই তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ওরা পরকালে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (হূদ ১১/১৮-২২)।
আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ সমূহের মধ্যে সীমালংঘন অন্যতম অপরাধ। এজন্য তাঁর বাণীতে বিঘোষিত হয়েছে, إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِيْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে ভালবাসেন না (বাক্বারাহ ২/১৯০)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, وَالظَّالِمُوْنَ مَا لَهُمْ مِّن وَلِيٍّ وَلاَ نَصِيْرٍ ‘সীমালংঘনকারীদের কোন অভিভাবক নেই, কোন সাহায্যকারীও নেই’ (শূরা ৪২/৮)।
এ পৃথিবীর সব সৃষ্টি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। মানুষ আল্লাহর ইবাদত উপাসনা করবে, এটাই তার কর্তব্য। কিন্তু শয়তানের খপ্পরে পড়ে সে নিজ কর্তব্য থেকে বিস্মৃত হয়, প্রবৃত্ত হয় পাপাচারে, জড়িয়ে পড়ে সীমালংঘনের কাজে। কিন্তু মহিমাময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয়তম মানব জাতিকে নিজের সন্তুষ্টির অনুকূলে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য এবং অসন্তুষ্টির কাজ থেকে প্রতিরোধ কল্পে পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বহু আয়াতের অবতারণা করেছেন। এতদ্ব্যতীত মানব জাতিকে ইহকালে ও পরকালে নিরাপদে রাখতে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তবুও শয়তানের দুর্দান্ত কৌশলের সামনে হতভাগা মানুষ পরাজিত হয়। শয়তানের মিথ্যা প্ররোচনায়, প্রতারণায়, প্রলোভনে বহু মানুষ অহরহ পথভ্রষ্ট হচ্ছে। এদের একদল মহাজ্ঞানী আল্লাহর সমালোচনা করে, যা অনধিকার চর্চার নামান্তর এবং অমার্জনীয় অপরাধ।
উপরের আয়াতগুলোতে সীমালংঘনের প্রাথমিক দিকসমূহ আলোচিত হয়েছে। মানব জীবনের যে কোন কর্মকান্ডে আল্লাহ প্রদর্শিত বিধি-বিধানের বিরোধিতা করাই সীমালংঘন। যেমন- যে ব্যক্তি কুরআনে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী বিচার-ফায়ছালা করে না, আল্লাহ তা‘আলা তাকে সীমালংঘনকারী তথা যালিম হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি বলেন, وَمَنْ لَّمْ يَحْكُمْ بِمَا أنْزَلَ اللهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ ‘যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের অনুযায়ী ফায়ছালা করে না তারাই সীমালংঘনকারী (যালিম)’ (মায়েদাহ ৫/৪৫)।
একইভাবে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনকারী ও হৃদ্যতা পোষণকারীদেরকেও তিনি সীমালংঘনকারী বলেছেন।
যেমন তিনি কলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُوا الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَّتَوَلَّهُمْ مِّنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ-
‘হে বিশবাসীগণ ! তোমরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না, তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পথ প্রদর্শন করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৫১)।
সীমালংঘন হ’তে অব্যাহতি লাভের অপর এক পদ্ধতির বর্ণনায় প্রত্যাদেশ এসেছে,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ لاَ تُحَرِّمُواْ طَيِّبَاتِ مَا أَحَلَّ اللهُ لَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُواْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ-
‘হে বিশ্বাসীগণ ! তোমরা ঐসব পবিত্র বস্ত্ত হারাম করো না, যেগুলো আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন এবং সীমা অতিক্রম করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পসন্দ করেন না’ (মায়েদাহ ৫/৮৭)।
একই মর্মার্থে অন্যত্র বলা হয়েছে,
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ
‘আল্লাহর হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক সীমালংঘনকারী (যালিম) কে ? নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী কওমকে পথ দেখান না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।
সীমালংঘনকারীদের পারস্পরিক ঘনিষ্টতা অত্যন্ত নিবিড়। মহান আল্লাহ বলেন, وإِنَّ الظَّالِمِيْنَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَاللهُ وَلِيُّ الْمُتَّقِيْنَ ‘সীমালংঘনকারীরা একে অপরের বন্ধু, আর আল্লাহ পরহেযগারদের বন্ধু’ (জাছিয়া৪৫/১৯)।
আল্লাহ তাঁর প্রিয় ও বিশ্বাসী বান্দাদের আরও অধিক অনুপ্রেরণা সৃষ্টির প্রয়াসে এবং পথভ্রষ্টদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বহু প্রত্যাদেশ পাঠিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,
يُثَبِّتُ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُواْ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ وَيُضِلُّ اللهُ الظَّالِمِيْنَ وَيَفْعَلُ اللهُ مَا يَشَاءُ-
‘আল্লাহ তা‘আলা ইহকালে ও পরকালে বিশ্বাসীদের অন্তরকে প্রতিষ্ঠিত বাক্য দ্বারা আরও মযবূত করেন এবং সীমালংঘনকারীদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখেন। আর তিনি যা ইচ্ছা তাই করে থাকেন’ (ইবরাহীম ১৪/২৭)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ادْعُواْ رَبَّكُمْ تَضَرُّعاً وَخُفْيَةً إِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ ‘তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে এবং সঙ্গোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদেরকে পসন্দ করেন না’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)।
ইবলীসই প্রথম সীমালংঘন করে এবং সে মানব জাতিকে সীমালংঘনে অহরহ উৎসাহিত করে। সে মানুষের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং তার দ্বারা অন্য মানুষকে সীমালংঘনের আমন্ত্রণ জানায়। যারা জানে না এবং আল্লাহ পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে না, এমনকি আল্লাহর অসীম ক্ষমতায়ও বিশ্বাস করে না, তারাই সীমালংঘনে অগ্রসর হয়। মূলতঃ তাদের যথাযথ জ্ঞান থাকলে এবং আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করলে কোন মানুষই সীমালংঘন করতে পারে না।
আল্লাহ ছাড়া মানুষের কোন প্রকৃত হিতাকাংখী নেই। তিনি মানুষকে সর্বাধিক ভালবাসেন। তাই সীমালংঘনসহ বড়-ছোট সকল প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য আল-কুরআন অবতীর্ণ করেন। উক্ত গ্রন্থ আমাদের জীবনের একমাত্র সম্বল। এই কিতাবের অবমাননা করলে বা নিজ ইচ্ছানুযায়ী কাজ করলে সে সীমালংঘনকারী হিসাবে গণ্য হবে। এজন্য যারা এ কিতাব মানে না বা বিশ্বাস করে না তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতেও নিষেধ করা হয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষ এ বন্ধুত্বে ক্ষতিগ্রস্তই হবে। তাছাড়াও আল্লাহর অন্যান্য মঙ্গলময় বিধানের প্রতি অবহেলা করে নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করলেও সীমালংঘনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। উপরোক্ত আয়াতগুলো সীমালংঘনের কবল হ’তে মুক্তি লাভের অন্যতম উপদেশ ও জ্ঞানলাভের নিদর্শন হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বের ঘরে-বাইরে, শহরে-বন্দরে, অফিসে-আদালতে, স্কুলে-কলেজে, মসজিদে-মন্দিরে, যানবাহনে সর্বত্র বড়-ছোট অনেক কাজে সীমালংঘন করা হচ্ছে। ইহজগতের স্বার্থে জড়িত এসব সীমালংঘন মানুষের পক্ষে যেন এখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাকে মানুষ এখন একটা সাধারণ ব্যাপারই মনে করছে। যদিও আল্লাহ কোন অপরাধীকে কখনও নিষ্কৃতি দেবেন না। আল্লাহ পরকালে বিচার করবেনই।
আল্লাহই মানব জাতি ও তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। তিনি ভালভাবেই জানেন কারা বিশ্বাসী এবং কারা অবিশ্বাসী। তিনি মুমিন বা বিশ্বাসীদের অন্তরকে ইয়াক্বীন তথা দৃঢ় বিশ্বাসে আরো মযবূত করেন এবং কাফির বা অবিশ্বাসী ও সীমালংঘনকারীদেরকে নিজেদের ইচ্ছার উপরে ছেড়ে দেন। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত বান্দাদের সীমালংঘন ও অন্যান্য পাপকাজ হ’তে রক্ষার জন্য তাঁর নিকট অতি নির্জনে সকাতর প্রার্থনা করার আদেশ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বান্দার প্রতি অসীম প্রেমময় আল্লাহর ভালবাসাই প্রতিফলিত হয়েছে।
মহান আল্লাহ তাঁর অপরাধী বা পাপী বান্দাকেও ভালবাসেন, এজন্য তিনি তওবার বিধান দিয়েছেন। কি পরিমাণ অপরাধী বা পাপীকে তিনি ক্ষমা করবেন বা পবিত্র করবেন তা অবশ্য তিনিই ভাল জানেন। তবে তওবার মাধ্যমে এসব থেকে পবিত্র হওয়ার ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হয়।
মহান আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ رَبَّكَ لَذُوْ مَغْفِرَةٍ لِّلنَّاسِ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَإِنَّ رَبَّكَ لَشَدِيْدُ الْعِقَابِ ‘মানুষের সীমালংঘন সত্ত্বেও আপনার প্রতিপালক মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল, আর আপনার পালনকর্তা শাস্তিদানেও কঠোর’ (রা‘দ১৩/৬)। একই মর্মার্থে অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, يُدْخِلُ مَنْ يَّشَاءُ فِيْ رَحْمَتِهِ وَالظَّالِمِيْنَ أَعَدَّ لَهُمْ عَذَاباً أَلِيْماً ‘তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর রহমতে দাখিল করেন। কিন্তু (যালেম) সীমালংঘনকারীদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন ভয়ানক শাস্তি’ (দাহার ৭৬/৩১)।
উপরে উদ্ধৃত আয়াত দু’টি নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনার রূপ পরিগ্রহ করেছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল; তওবার মাধ্যমে তিনি বান্দার পাপ মার্জনা করেন।
যারা আল্লাহর অপার মহিমায় বিশ্বাসী তারা ইহকালে ও পরকালে উপকৃত হবে। আর যারা এর বিপরীত চিন্তায় মগ্ন তথা অবিশ্বাসী তারা ইহকালেও অভিশপ্ত এবং পরকালে আরও ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, অবিশ্বাসীদের সঞ্চিত পাপরাশি তাদেরকে পৃথিবীর বুকেই প্রত্যক্ষভাবে আক্রমণ করে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। পবিত্র কুরআনে সীমালংঘনকারী পাপীদের ঐতিহাসিক ধ্বংসকাহিনী সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত আছে। মানুষকে সীমালংঘনের মত পাপের অকল্পনীয় শাস্তি হ’তে নিরাপদ থাকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে প্রাচীন কালের কতিপয় ধ্বংসকাহিনী এখানে তুলে ধরা হ’ল।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَكَمْ قَصَمْنَا مِنْ قَرْيَةٍ كَانَتْ ظَالِمَةً وَأَنشَأْنَا بَعْدَهَا قَوْماً آخَرِيْنَ- فَلَمَّا أَحَسُّوْا بَأْسَنَا إِذَا هُم مِّنْهَا يَرْكُضُوْنَ- لاَ تَرْكُضُوْا وَارْجِعُوْا إِلَى مَا أُتْرِفْتُمْ فِيْهِ وَمَسَاكِنِكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْأَلُوْنَ- قَالُوْا يَا وَيْلَنَا إِنَّا كُنَّا ظَالِمِيْنَ- فَمَا زَالَت تِّلْكَ دَعْوَاهُمْ حَتَّى جَعَلْنَاهُمْ حَصِيْداً خَامِدِيْنَ-
‘আমি কত জনপদের ধ্বংস সাধন করেছি যার অধিবাসীরা ছিল সীমালংঘনকারী এবং তাদের পর সৃষ্টি করেছি অন্য জাতি। অতঃপর যখন তারা আমার আযাবের কথা টের পেল, তখনই তারা সেখান থেকে পলায়ন করতে লাগল। পলায়ন করো না এবং ফিরে এসো, যেখানে তোমরা বিলাসিতায় মত্ত ছিলে ও তোমাদের আবাসগৃহে। সম্ভবতঃ কেউ তোমাদের জিজ্ঞেস করবে। তারা বলল, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা অবশ্যই সীমালংঘনকারী ছিলাম। তাদের এই আর্তনাদ সব সময় ছিল, শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে করে দিলাম যেন কর্তিত শস্য ও নির্বাপিত অগ্নি’ (আম্বিয়া২১/১১-১৫)।
একই বিষয়ে অন্যত্র প্রত্যাদেশ এসেছে, وَتِلْكَ الْقُرَى أَهْلَكْنَاهُمْ لَمَّا ظَلَمُوْا وَجَعَلْنَا لِمَهْلِكِهِمْ مَّوْعِداً ‘এসব জনপদ, যাদেরকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, যখন তারা সীমালংঘন করেছিল এবং আমি তাদের ধ্বংসের জন্য একটা প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করেছিলাম’ (কাহফ ১৮/৫৯)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَكَأَيِّن مِّن قَرْيَةٍ أَمْلَيْتُ لَهَا وَهِيَ ظَالِمَةٌ ثُمَّ أَخَذْتُهَا وَإِلَيَّ الْمَصِيْرُ ‘আমি কত জনপদকে অবকাশ দিয়েছি। এমতাবস্থায় যে, তারা সীমালংঘনকারী ছিল। এরপর তাদেরকে পাকড়াও করেছি এবং আমার কাছেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে’ (হজ্জ ২২/৪৮)।
কুরআন মজীদে ঐসব জনপদ ধ্বংসের কারণও উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَقَدْ جَاءَهُمْ رَسُوْلٌ مِّنْهُمْ فَكَذَّبُوْهُ فَأَخَذَهُمُ الْعَذَابُ وَهُمْ ظَالِمُوْنَ ‘তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল আগমন করেছিলেন; অনন্তর ওরা তাঁর প্রতি মিথ্যারোপ করল। তখন আযাব এসে ওদেরকে পাকড়াও করল এবং নিশ্চিতই ওরা ছিল সীমালংঘনকারী’ (নাহল ১৬/১১৩)।
উপরোক্ত আয়াতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আরও কিছু আয়াত এসেছে,
وَمَا كَانَ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى حَتَّى يَبْعَثَ فِيْ أُمِّهَا رَسُوْلاً يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِنَا وَمَا كُنَّا مُهْلِكِي الْقُرَى إِلاَّ وَأَهْلُهَا ظَالِمُوْنَ-
‘আপনার পালনকর্তা জনপদসমূহকে ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ না করেন, যিনি তাদের কাছে আমার আয়াত সমূহ পাঠ করেন এবং আমি জনপদসমূহকে তখনই ধ্বংস করি, যখন তার বাসিন্দারা সীমালংঘন করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৯)।
উপরোক্ত জনপদ সমূহের নানাবিধ সীমালংঘনের মধ্যে শিরক ছিল অন্যতম। আল্লাহ বলেন, وَيَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَاناً وَمَا لَيْسَ لَهُمْ بِهِ عِلْمٌ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِن نَّصِيْرٍ- ‘তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর পূজা করে, যার কোন সনদ নাযিল করা হয়নি এবং সে সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই। বস্ত্ততঃ সীমালংঘনকারীদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (হজ্জ ২২/৭১)।
উপরের আয়াতগুলোতে প্রাচীনকালের ধ্বংস কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর বাস্তব নমুনা এখনও সে দেশগুলোতে চিহ্নিত হয়ে আছে। যেখানে তারা ধ্বংস হয়েছিল। বিশ্ববিখ্যাত অত্যাচারী ও নাফরমান ফেরআউনের কাহিনীও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। বিশ্ববাসীর সন্দেহ দূরীকরণার্থে মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউনের লাশকে অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন তার জন্মভূমিতে। মিশরের যাদুঘরে আজও তার লাশ পবিত্র কুরআনের সত্যতার মহা স্বাক্ষর বহন করছে। মহান আল্লাহ বলেন, مِنْ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ كَانَ عَالِياً مِّنَ الْمُسْرِفِيْنَ ‘ফেরআউন, সে ছিল সীমালংঘনকারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়’ (দুখান৪৪/৩১)। তার কওমকে সমূলে নদীগর্ভে নিমজ্জিত করা হয়েছিল। এতদ্ব্যতীত নূহ (আঃ)-এর কওম, লূত (আঃ)-এর কওম, হূদ (আঃ)-এর কওম, ছামূদ (আঃ)-এর কওম, শোয়াইব (আঃ)-এর কওম ধ্বংসের নির্মম কাহিনী আজও আল্লাহভীরু বান্দাদের সংশোধনের ক্ষেত্রে অনন্য উপকরণ। ঐসব কওমের লোকেরা তাদের নবী-রাসূলদের আনুগত্য করত না, বিশ্বাসও করত না, বরং তাঁদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। এমনকি কখনও তাঁদেরকে হত্যাও করত।
বর্তমানে উম্মতে মুহাম্মাদীর জ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই নবী (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর। এরা বিশ্বাস করে আল্লাহর বিধান ও রাসূলের বিরোধিতা করলে সীমালংঘনের শিকার হ’তে হবে এবং অনিবার্য ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। কারণ মহান আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)-কে বলেছেন, ‘আপনার যে কল্যাণ হয় তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর আপনার যে অকল্যাণ হয়, সেটা হয় আপনার নিজের কারণে’ (নিসা ৪/৭৯)।
সুতরাং পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা বা দেশে যেসব দুর্যোগ বা প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছে, তা সেখানকার অধিবাসীদের সীমালংঘনের কারণেই হয়েছে। সাম্প্রতিকালের ঘন ঘন ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, সুনামি, হ্যারিকেন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির বিধ্বংসী ছোবলও সেখানকার অধিবাসীদের অন্যায়-অত্যাচার ও সীমালংঘনেরই ফল। তবে ইহকালের এসব ধ্বংসলীলা, ক্বিয়ামতের আসন্ন ধ্বংসযজ্ঞের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُوْنَ مَا لَبِثُوْا غَيْرَ سَاعَةٍ كَذَلِكَ كَانُوْا يُؤْفَكُوْنَ ‘যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম খেয়ে বলবে যে, এক মুহূর্তেরও বেশী অবস্থান করিনি। এমনিভাবে তারা সত্য বিমুখ হ’ত’ (রূম ৩০/৫৫)।
অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, فَيَوْمَئِذٍ لاَّ يَنْفَعُ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مَعْذِرَتُهُمْ وَلاَ هُمْ يُسْتَعْتَبُوْنَ ‘সেদিন সীমালংঘনকারীদের ওযর-আপত্তি তাদের কোন উপকারে আসবে না এবং তওবা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সুযোগও তাদের দেয়া হবে না’ (রূম৩০/৫৭)। একই মর্মাথে অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِذَا رَأى الَّذِيْنَ ظَلَمُوا الْعَذَابَ فَلاَ يُخَفَّفُ عَنْهُمْ وَلاَ هُمْ يُنْظَرُوْنَ ‘যখন সীমালংঘনকারীরা আযাব প্রত্যক্ষ করবে, তখন তাদের থেকে তা লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে কোন অবকাশ দেয়া হবে না’ (নাহল ১৬/৮৫)।
ক্বিয়ামত দিবসে সীমালংঘনকারীদের শোচনীয় দুরবস্থার বর্ণনায় প্রত্যাদেশ হয়েছে, ‘যদি সীমালংঘনকারীদের কাছে পৃথিবীর সবকিছু থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে, তবে অবশ্যই তারা ক্বিয়ামতের দিন সে সবকিছুই নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মুক্তিপণ হিসাবে দিয়ে দিবে। তারা দেখতে পাবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন শাস্তি, যা তারা কল্পনাও করত না। আর দেখবে তাদের দুষ্কর্মসমূহ এবং যে বিষয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তা তাদেরকে ঘিরে নেবে’ (যুমার ৩৯/৪৭-৪৮)।
সীমালংঘন সম্পর্কে অপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যে,
فَإِذَا جَاءَتِ الطَّامَّةُ الْكُبْرَى- يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ مَا سَعَى- وَبُرِّزَتِ الْجَحِيْمُ لِمَنْ يَّرَى- فَأَمَّا مَنْ طَغَى- وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- فَإِنَّ الْجَحِيْمَ هِيَ الْمَأْوَى-
‘যখন মহাসংকট এসে যাবে, সেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম স্মরণ করবে এবং দর্শকদের জন্য জাহান্নাম প্রকাশ করা হবে। তখন যে ব্যক্তি সীমালংঘন করেছে এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম’ (নাযি‘আত ৭৯/৩৪-৩৯)।
ক্বিয়ামত দিবসের জটিলতার আরও সংবাদ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ يَوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِيْنَ- الَّذِيْنَ يُكَذِّبُوْنَ بِيَوْمِ الدِّيْنِ- وَمَا يُكَذِّبُ بِهِ إِلاَّ كُلُّ مُعْتَدٍ أَثِيْمٍ- إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا قَالَ أَسَاطِيْرُ الْأَوَّلِيْنَ- كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوْبِهِم مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ- كَلاَّ إِنَّهُمْ عَن رَّبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوْبُوْنَ- ثُمَّ إِنَّهُمْ لَصَالُوا الْجَحِيْمِ-
‘সেদিন দুর্ভোগ মিথ্যারোপকারীদের, যারা ক্বিয়ামত দিবসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। প্রত্যেক সীমালংঘনকারী পাপীই কেবল একে মিথ্যারোপ করে। তার কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হ’লে সে বলে, পুরাকালের উপকথা। কখনও না, বরং তারা যা করে, তাই তাদের হৃদয়ে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। তারা সেদিন তাদের পালনকর্তার থেকে পর্দার আড়ালে থাকবে। অতঃপর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে’ (মুতাফফিফীন ৮৩/১০-১৬)।
উপরোক্ত আলোচনায় মানুষের জীবনের পাপরাশির সর্বোচ্চ পাপকে বোঝান হয়েছে। এরূপ পাপ সংগ্রহকারী ও বহনকারী যদি সারাজীবনে তার কৃত পাপের জন্য বিন্দুমাত্রও বিচলিত না হয় কিংবা অনুতপ্তও না হয়, তবে নিঃসন্দেহে সে সীমালংঘনকারীই থাকবে। আর যদি আল্লাহর রহমতে নিজের মানসিক চেতনায় কেউ অনুতপ্ত হয়ে সীমালংঘনের পরেও যে কোন পর্যায়ে অন্ততঃ মৃত্যুর পূর্বে হ’লেও আল্লাহর শরণাপন্ন হয়, ক্ষমাপ্রার্থী হয়, তাহ’লে তার ঐ অপরাধ ক্ষমা হ’তে পারে।
আল্লাহ মহাজ্ঞানী কৃপাশীল, দয়াশীল, ক্ষমাশীল, অনুগ্রহশীল, ধৈর্যশীল, সুবিচারক, মহাউন্নত, শ্রেষ্ঠ বাদশাহ ইত্যাদি অসীম গুণের অধিকারী। সুতরাং জীবন যাত্রার ক্ষেত্রে মানুষ সামান্যতম অবনত চিন্তায় আত্মসমর্পণ করলেও মুক্তির পথ পেতে পারে এবং দয়াশীল আল্লাহ তাকে ক্ষমাও করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য তাঁর দেখানো পথে না চললে এবং তাঁর নিষিদ্ধ পথকে বর্জন না করলে, তিনি যতই ক্ষমাশীল ও করুণাময় হোন না কেন, ঐ পাপী ব্যক্তি উদ্ধত-দুর্বিনীত সীমালংঘনকারী আল্লাহর ক্ষমা পাবে না।
পরিশেষে বলব, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাঁর প্রদর্শিত পথে চলে তাঁর সন্তোষ লাভ করার এবং অসন্তোষ থেকে মুক্তি অর্জনের তাওফীক দান করুন- আমীন!