হিলফুল ফুজুল : নবীজীবনের আদর্শ

হিলফুল ফুজুল একটি চুক্তির নাম। চুক্তি না বলে অঙ্গীকার বললেই যথার্থ হয়। ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে জাহেলি যুগে আরবের কোরাইশ বংশ এ অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিল মজলুম মানুষকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। ইসলামে বছরের চারটি মাস অতিশয় পবিত্র ও সম্মানিত। এগুলো হলো জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। আরবদের কাছেও সুদীর্ঘ অতীত থেকে মাস চারটি সম্মানিত ও পবিত্র গণ্য হতো। এই চার মাসে যুদ্ধবিগ্রহ ও রক্তপাত হারাম। কিন্তু এই সম্মানীয় মাসের পবিত্রতা লঙ্ঘিত হয়েছিল পরপর চার বছরের যুদ্ধে। এজন্য আরবরা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছিল হারবুল ফুজ্জার বা পাপবিদ্ধ লড়াই। মহানবী (সা.) এর বয়স যখন বিশের কোটায় তখন কোরাইশদের মধ্যে এ অন্যায় রক্তপাতের বিরুদ্ধে চেতনা তীব্রতর হয়। যুদ্ধে দুই পক্ষের নিহত লোকদের সংখ্যার তুলনায় প্রতিপক্ষে নিহতের অতিরিক্ত সংখ্যার জন্য রক্তপণ আদায় করে কোরাইশরা। এভাবে ফুজ্জারের যুদ্ধ সমাপ্ত হয় শাওয়াল মাসে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজে জননিরাপত্তা চরমভাবে ভেঙে পড়েছিল আগে থেকেই। বিশেষভাবে দুর্বল ও মজলুম মানুষের জীবন হয়ে উঠেছিল চরম দুর্বিষহ। বাইরে থেকে কাবাঘর জিয়ারতে যারা আসত, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও ভাবিয়ে তোলে সবাইকে। বিশেষ করে চার বছর স্থায়ী যুদ্ধও ছিল জননিরাপত্তা লঙ্ঘনের একটি ঘটনার ভয়াবহ পরিণাম। কাজেই কোরাইশ নেতারা চিন্তা করলেন আমাদের মজলুম মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম যে ব্যক্তি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন তিনি ছিলেন নবী করিম (সা.) এর চাচা জুবাইর ইবনে আবদুল মোত্তালিব। নবী করিম (সা.) এই চুক্তির স্মৃতিচারণ করে বলেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, আমি আমার চাচাদের সঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে জাদআনের ঘরে একটি অঙ্গীকারের সময় উপস্থিত ছিলাম। এই চুক্তির বিনিময়ে আমাকে লালবর্ণের উটনী দেয়া হলেও আমি তা পছন্দ করব না। যদি ইসলামের যুগে এই চুক্তির আওতায় আমাকে কোনো আহ্বান জানানো হয়, আমি সে ডাকে সাড়া দেব। (ফিকহুস সিরাহ, পৃ. ৭২)। হিলফুল আল্লামা নুবাইরির বর্ণনায় অঙ্গীকারটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায়। জুবাইর ইবনে মুতএম বলেন, রাসূলে পাক (সা.) বলেন, আমাকে যদি লালবর্ণের উটও দেয়া হতো, তবুও ইবনে জুদআনের ঘরে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল এবং তাতে আমি উপস্থিত ছিলাম, তা ভঙ্গ করা আমি পছন্দ করতাম না। সেই চুক্তিতে বনি হাশিম, বনি জুহরা ও বনি তিম গোত্রগুলো এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে, তারা সব সময় মজলুমের সাহায্য করবে। মজলুমদের মধ্যে কেউ যদি সেই চুক্তির বরাতে এখনও আমার কাছে সাহায্য চায়, আমি তাকে অবশ্যই সাহায্য করব। চুক্তিটি ছিল হিলফুল ফুজুল। (নুুবাইরি : পৃ. ১/১০১)। ইবনে হিশাম বলেন, তারা এই মর্মে অঙ্গীকার ও চুক্তিবদ্ধ হয় যে, মক্কার অধিবাসী বা অন্য জায়গার কোনো মজলুম মানুষ যদি মক্কায় প্রবেশ করে, তাকে তারা সহায়তা দেবে এবং যে ব্যক্তি তার ওপর জুুলুম করবে, তার সঙ্গে তারা লড়াই করবে, যতক্ষণ না মজলুমের হক উদ্ধার হয়। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৪১)। ওয়াকেদি বলেন, জুরহুম সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোক, যাদের নাম ছিল ফজল, ফুজালা, ফেজাল ও মুফাজজাল, তারা এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেছিল। কাজেই কোরাইশরা এই চুক্তি সম্পাদনের সময় তাদের নামানুসারে এর নামকরণ করে। (আল আগানি : ১৬/৭০)। কোরআন মজিদের ভাষ্য অনুসারে নবীজির সমগ্র জীবন আমাদের জন্য আদর্শ। কাজেই আমাদের যুব সমাজের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে নবীজির যৌবনকালের মধ্যে। যৌবনের প্রারম্ভে ২০ বছর বয়সে হিলফুল ফুজুল গঠনে নবীজির ভূমিকা, ২৫ বছর বয়সে কাবাঘর নির্মাণ শেষে কালো পাথর স্থাপন নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিপদ থেকে জাতিকে রক্ষা করা, সুন্দর চরিত্র মাধুর্যের কারণে আল আমিন বা সর্বমহলে পরম বিশ্বাসী উপাধি লাভ, ব্যবসা পরিচালনায় সততা, আমানতদারি ও সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ আরবের ধনবতী মহিলা খাদিজাতুল কুবরার হৃদয় জয় করা, অভাবী, অনাথ, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবতার সেবায় এগিয়ে যাওয়া প্রভৃতি গুণের সমাবেশ ঘটেছিল নবীজির যৌবনকালে। যার সাক্ষী দিয়েছিলেন সহধর্মিণী বিবি খাদিজাতুল কুবরা (রা.)। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রথম ওহি লাভের পর কম্পিত দেহে বাড়ি ফিরে তিনি যখন অস্বাভাবিক ঘটনা স্ত্রীকে জানিয়ে বললেন, তোমরা আমাকে চাদর মুড়ে দাও, চাদরে মুড়ে দাও, সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে খাদিজা (রা.) অভয় দিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করলেন, যা ছিল নবীজির যৌবনকালের কর্মময় সাধনার বাস্তব চিত্র। তিনি বললেন, আল্লাহ কখনও আপনাকে অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারি করেন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্গত মানুষকে সাহায্য করেন। (বোখারি শরিফ : ৩)। কতখানি সুন্দর, অনুপম ও মধুর চরিত্রের অধিকারী হলে নিজের স্ত্রী এমন সাক্ষ্য দিতে পারে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে তা এক বিস্ময়কর গবেষণার বিষয়। বস্তুত যৌবনের প্রারম্ভে নবি করিম (সা.) হিলফুল ফুজুল গঠনের মাধ্যমে যুব সমাজের জন্য যে আদর্শ স্থাপন করেছেন তা ছিল মজলুমকে সাহায্য করার আদর্শ। বর্তমানে তরুণ সমাজে নানা নামে সমিতি বা ক্লাব গঠনের রেওয়াজ আছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এর অধিকাংশই খেলাধুলার পেছনে সময় নষ্ট করা বা বস্তুগত সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে নিয়োজিত। ফলে এর দ্বারা সমাজ কাক্সিক্ষত সুফল লাভ করতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের তরুণ সমাজ নবীজির জীবন থেকে আদর্শ গ্রহণ করে সমাজের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে। হিলফুল ফুজুল থেকে প্রেরণা নিয়ে অসহায় দুর্বল মানুষদের সাহায্য করতে পারে। গরিব ঘরের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগাতে পারে। রাস্তাঘাট, স্কুল, মাদরাসা নির্মাণে সহায়তা দান করতে পারে। কারণ, বস্তুতান্ত্রিক সমাজে জীবনযুদ্ধে পরাজিত গরিব মানুষই আজ প্রকৃত মজলুম। সূত্র- ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী: আলোকিত বাংলাদেশ।