Drawer trigger

ইরান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও আধিপত্যকামী ব্যবস্থার বিরোধী : আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী

ইরানের ইসলামী বিপ্লব ৩১ বছর পেরিয়ে ৩২ তম বছরে পদার্পণ করেছে। এ সূদীর্ঘ সময়ে পশ্চিমা সরকার ও তাদের প্রচার-যন্ত্রগুলো সব সময়ই এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে এ বিপ্লবের প্রতি জনগণের সমর্থন কমে যাচ্ছে এবং ইরানের ইসলামী সরকারের ক্ষমতাও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে ইরানের মুসলিম জাতি প্রায়ই বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ইসলামী বিপ্লব ও ইরানের নির্বাচিত ইসলামী সরকারের প্রতি তাদের অবিচল আস্থা বা আনুগত্য স্বেচ্ছায় ও স্বতস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করছে। ইসলামী বিপ্লবের ৩১ তম বিজয়-বার্ষিকী উপলক্ষ্যে গত ১১ ই ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী গণ-শোভাযাত্রায় কোটি কোটি মানুষের অংশগ্রহণ ছিল এরকমই এক দৃষ্টান্ত। ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে, ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান অবস্থা আগের মতই এমনকি আগের চেয়েও শক্তিশালী এবং এর অগ্রযাত্রাও দূর্বার গতিতে অব্যাহত রয়েছে। আজকের এই আলোচনায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করবো। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের ইসলামী সরকার ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের তীব্র ক্ষোভসহ এতসব ষড়যন্ত্রের অন্যতম প্রধান কারণ হল, এ বিপ্লবের ফলে বহু বছর ধরে ইরানের সম্পদ অবাধে শোষণ ও লুটপাটের যে সুবিধে পাশ্চাত্য ভোগ করছিল তা বন্ধ হয়ে গেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ইসলামী বিপ্লবের আগে বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলো ইরানকে মালিকবিহীন সম্পদ-ভান্ডার বলে মনে করত এবং ওরা ইচ্ছে মত এ দেশের সম্পদ লুট করত। কিন্তু ইরানের সচেতন জাতি লুটপাটের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ায় এবং প্রতিরোধ ও স্বাধীনতাকামীতা প্রদর্শন করায় এইসব ‘অপরাধের' জন্য তারা বিশ্বের আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর ক্ষোভ ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর মোকাবেলায় ইরানী জাতির প্রতিরোধ নির্যাতিত অন্য জাতিগুলোর জন্য অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইরানী জাতির প্রতিরোধ ও অবিচলতার মোকাবেলায় বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলোর ব্যর্থতা এটা প্রমাণ করেছে যে, কোনো জাতি যদি আত্ম-মর্যাদা, নিজের স্বাভাবিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস এবং খোদায়ী বিশ্বাস নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয় তাহলে বিশ্বের কোনো শক্তিই ঐ জাতির ইচ্ছার বিরোধী কিছু করতে সক্ষম হবে না। ইরানের মুসলিম জাতির প্রতিরোধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিলিস্তিনী, ইরাকী, লেবাননী ও আফগান জাতিসহ বিশ্বের অনেক জাতি স্বাধিকার আদায় বা অধিকার রক্ষায় দর্শনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। অন্য কোনো শক্তির ওপর নির্ভর না করে কেবল মানব জাতির মুক্তির বিধান তথা ইসলামের ওপর নির্ভর করা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এটাই এ বিপ্লবের টিকে থাকার প্রধান রহস্য। ইরানী জনগণ একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে এ বিপ্লবকে বিজয়ী করেছে এবং একইভাবে এ বিপ্লবকে রক্ষা করছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, পবিত্র কোরআনের সূরা ইব্রাহীমে উল্লেখিত উপমার মত ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবও এমন একটি পবিত্র বৃক্ষের মত যার গগণস্পর্শী শাখাগুলো সব সময়ই ফলবান ও উর্বর জমিতে প্রবর্ধমান এবং এ বৃক্ষের রয়েছে অত্যন্ত মজবুত শেঁকড়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইসলামী বিপ্লব ও এর সাফল্যগুলোর স্থায়ীত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, "বিশ্বের বহু দেশেই বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের নামে সরকার পরিবর্তনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এসবই কেবল একবার ব্যবহারের যোগ্য পণ্যের মত ক্ষণস্থায়ী হয়েছে। সংক্ষিপ্ত কিছু সময়ের পর এসব দেশে আবার আগের অবস্থা ফিরে এসেছে, কিংবা কোনো কোনো সময় অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। কিন্তু সত্য বা বাস্তবতা এমন নয়। তা টিকে থাকে।" ইরানের ইসলামী বিপ্লব ৩১ বছর পরও তার ঘোষিত সেই একই লক্ষ্যগুলোর পানে এগিয়ে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই এ বিপ্লব আরো উজ্জ্বল ও বেগবান হয়ে উঠছে। উচ্চতর লক্ষ্য-অভিসারী ও জুলুম-বিরোধী এ বিপ্লবের শক্তি দিনকে দিন বাড়ছে বলেই পাশ্চাত্য এ বিপ্লবের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আমরা বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলোর নেতিবাচক প্রচারণার বিপরীতে মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে বীরত্ব ও সম্মানের চেতনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। এ পর্যন্ত ইরানের মুসলিম জাতি ও ইসলামী সরকারের প্রচেষ্টার ফলে ইসলামী জাগরণ জোরদার হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ও বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জাতিগুলোর ক্ষোভ দিনকে দিন বাড়ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সাথে দ্বন্দ্বের ব্যাপারে ইরানের স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরে হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ''আমরা আমাদের মনের কথা বলতে ভীত নই। আমরা জানি যে আমাদের এ কথাগুলো বিশ্বের জাতিগুলোসহ অনেক সরকারেরই মনের কথা, তাই আমরা সেগুলো স্পষ্ট করে বলতে চাই। আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও আধিপত্যকামী ব্যবস্থার বিরোধী। বিশ্বের ভাগ্যের ওপর কয়েকটি দেশের একক কর্তৃত্বের তীব্র বিরোধী এবং আমরা এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। আমরা ওদেরকে বিশ্বের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। আর এটাও স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যবাদী বা আধিপত্যকামী শক্তিগুলোও আমাদের বিরোধী।'' গত আটই জুন ইরানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ঐ নির্বাচনে শতকরা ৮৫ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন। কিন্তু ঐ নির্বাচনে পরাজিত কোনো কোনো প্রার্থীর প্রতিবাদকে অজুহাত করে পশ্চিমা সরকার ও প্রচার মাধ্যমগুলো ইরান-বিরোধী প্রচারণার নতুন ধারা সূচিত করে। তারা গত ৮ মাসে দাবী করেছে যে, এ বিপ্লব ও সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন কমে যাচ্ছে এবং ইরানের ইসলামী সরকারের ক্ষমতাও ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে। ইরানের ভেতরেও একদল লোক এসব প্রচারণায় প্রভাবিত হয়েছে এবং কেউ কেউ অসাবধানতা ও অজ্ঞতাবশতঃ কিংবা শত্রুতাবশতঃ একই কথা বলেছেন। কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের ৩১ তম বিজয়-বার্ষিকী উপলক্ষ্যে গত ১১ ই ফেব্রুয়ারি রাজধানী তেহরানসহ দেশব্যাপী ইসলামী সরকারের সমর্থনে কোটি কোটি মানুষের গণ-শোভাযাত্রা তাদের দাবীকে মিথ্যায় ও বড় ধরনের কলঙ্কে রূপান্তরিত করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ ঘটনাকে ইসলামী বিপ্লবের আরো একটি মোজেজা বা অলৌকিক নিদর্শন বলে মন্তব্য করেছেন। শত্রুদের ঐসব প্রচারণার জবাবে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এবারের এই গণ-শোভাযাত্রায় অতীতের চেয়েও বেশী জনতা অংশ নিয়েছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এ শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে তেহরানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাতে চেয়েছিল ইসলামের শত্রুরা। কিন্তু জনগণের দূরদর্শিতা ও সচেতনতার কারণে তাদের ঐ ষড়যন্ত্র অংকুরেই বিনষ্ট হয়। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে, এই ঐতিহাসিক গণ-শোভাযাত্রায় সর্বস্তরের ইরানী জনগণ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়ায় এবং ইসলামের গৌরব ও বিশ্বাসের ওপর জোর দেয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র হতাশ হবার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। আর এই ক্ষোভ প্রকাশের জন্যই মার্কিন ও ইউরোপীয় কিছু কর্মকর্তা সম্প্রতি ইরানের পরমাণু কর্মসূচীকে সামরিক বলে আবারও জোর গলায় দাবী করেছেন। এ প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, আমরা বার বার বলেছি, মানব প্রজন্ম ধ্বংসকারী এ ধরনের অস্ত্র ইসলামের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। তাই এ ধরনের অস্ত্র তৈরিতে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসলামী বিপ্লব পথচ্যূত হয়েছে এমন দাবী সম্পর্কে দেশের বিভ্রান্ত কিছু লোকের দাবীর বিরোধীতা করে বলেছেন, বিপ্লব পথচ্যূত হলে এত ব্যাপক সংখ্যক ঈমানদার মানুষ বিপ্লবের প্রতি এভাবে সমর্থন জানাতো না। ইসলামী বিপ্লবের প্রতি যে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে নিজেই নিজের ক্ষতি করবে এবং বিপ্লব তার আলোকোজ্জ্বল পথে অগ্রযাত্রা ঠিকই অব্যাহত রাখবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। অন্যদিকে ইসলামী বিপ্লবের প্রতি অনুগত ব্যক্তিরা এর পুরস্কার হিসেবে ইহকালে সম্মান ও উচ্চতর লক্ষ্যগুলো অর্জনে সফল হবে এবং সবচেয়ে বড় পুরস্কার হিসেবে পরকালেও প্রতিদান পাবেন বলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা উল্লেখ করেন। ইরানী জাতি ইসলামী বিধান ও আদর্শের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ এবং অবিচল থাকায় তাদের বিপ্লব ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে ও তাদের ভবিষ্যৎও অত্যন্ত উজ্জ্বল হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইরানী জাতি ভবিষ্যতে সব জাতির জন্যই অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হবে বলেও তিনি ভবিষ্যদ্বানী করেন। (রেডিও তেহরান)