মিশরের পররাষ্ট্রনীতিতে ভঙ্গুর অর্থনীতির কালো ছায়া

বিপ্লব পরবর্তী মিশর এখন অনেকটাই স্থিতিশীল । শহরগুলো এখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত । সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের পতনের পর অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতা মুহাম্মদ মুরসি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি সাবেক সেচমন্ত্রী হিশাম কান্দিলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সম্প্রতি হিশাম কান্দিলের নেতৃত্বে একটি সরকারও গঠিত হয়েছে। সরকার গঠনের মধ্যদিয়েই প্রেসিডেন্ট মুরসির দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। নয়া সরকারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে এখন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ। নয়া সরকার পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। অবশ্য ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই বিষয়টি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের বিবেচনায় ছিল। এ কারণেই তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম প্রার্থী হিসেবে খেইরাত আল-শাতেরকে মনোনীত করেছিল। কারণ খেইরাত আল-শাতের অর্থনীতি ভালো বোঝেন এবং তিনি নিজেও একজন সফল ব্যবসায়ী। মিশরের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই এটা স্পষ্ট হয় যে, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। এ কারণে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্যে হলেও অন্য সবকিছুর চেয়ে অর্থনৈতিক স্বার্থকেই হয়তো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেবে নয়া সরকার। হোসনি মুবারকের পতনের আগে থেকেই মিশরে নানা অর্থনৈতিক সমস্যা বিরাজ করছিল। গণআন্দোলন ও অস্থিরতার কারণে সেসব সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। বর্তমানে মিশরে বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশ এবং প্রতিবছর সাত লাখ মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে । দারিদ্র আরো বেড়েছে। দেশটির ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের  দৈনিক আয় এক ডলারের নিচে । ৮ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। রয়েছে বাজেট ঘাটতি। সব মিলিয়ে মিশরের জীবনমান এবং মানবিক উন্নয়ন সূচকগুলো নিম্নমুখী। বর্তমানে মিশরের  বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি ডলার । ২০১১ সালে দেশটিতে বৈদেশিক পুজি বিনিয়োগের পরিমাণ ৯০ শতাংশ কমেছে। মিশরের জাতীয় আয়ের অন্যতম একটি উৎস হচ্ছে পর্যটন শিল্প। কিন্তু গণআন্দোলন তথা ইসলামি বিপ্লব শুরু হওয়ার কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে স্বাভাবিকভাবেই পর্যটকদের আসা-যাওয়া ব্যাপকভাবে কমে গেছে। পর্যটন খাতে চলছে স্থবিরতা। মিশরের মোট জাতীয় আয় বা জিএনআই'র প্রবৃদ্ধিও ৩.৮ শতাংশ থেকে কমে ১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মিশরের অর্থনৈতিক অঙ্গনের যে অবস্থা তার জন্য সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের নীতিই সবচেয়ে বেশি দায়ী। তবে গণআন্দোলনের কারণেও সাময়িকভাবে দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে কোন বড় লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে কিছু ছোটখাটো স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হয়। মিশরের জনগণ যে বড় সাফল্য অর্জন করেছে, তা দীর্ঘ মেয়াদে দেশটির জনগণের ভবিষ্যত উজ্জল করবে। বর্তমান পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারলে সব সমস্যারই সমাধান হবে। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যা অবশ্যই এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এই অবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জরুরি। কাজেই মিশরের নয়া সরকারকে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনা করতে হচ্ছে। দেশটির নয়া সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে চেষ্টা শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি ঘোষনা করেছেন, আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে সহযেগিতা জোরদারের বিষয়টি পররাষ্ট্রনীতিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। তিনি আরব দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন বাজার সৃষ্টির কথা বলেছেন। এর মধ্যদিয়েও মিশরের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি ফুটে ওঠেছে। মিশরের গণআন্দোলন ব্যর্থ করার জন্যে সৌদি আববের ব্যাপক ষড়যন্ত্র ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুবারকপন্থী প্রার্থী আহমাদ শফিকের প্রতি রিয়াদের সমর্থন সত্ত্বেও দায়িত্ব গ্রহণের পর মুহাম্মদ মুরসি সর্ব প্রথম সৌদি আরব সফর করেছেন। এ কাজটিও করা হয়েছে অর্থনৈতিক বিবেচনায়। হোসনি মোবরকের পতনের আগে থেকেই মিশরের অর্থনীতিতে সোদি আরবের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে মিশরে অনেকগুলো সৌদি কোম্পানি ততপর রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, সোদি কোম্পানিগুলো মিশরে প্রায় তিন হাজার কোটি ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। তবে ইরান এবং ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মিশরের পররাষ্ট্রনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আমেরিকা ও সৌদি আরবের বিরোধিতা সত্বেও ইরানের সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক দিন দিন জোরদার হচ্ছে। সম্পর্ক জোরদার হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- উভয় দিক থেকেই ইরান ও মিশর উপকৃত হবে। অন্যদিকে, ইসরাইলের সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরো শীতল হবে। যদিও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কারণে মিশর এখনই হয়তো ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সাহস দেখাবে না। বিপ্লব পরবর্তী মিশরকেও মুবারকের আমলের মতোই বৈদেশিক ঋণ,পুঁজি ও সাহায্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকতে হবে। এ কারণে মিশর সরকার এখনই পাশ্চাত্যের ব্যাপারে কোন চ্যালেঞ্জিং ভূমিকা নিতে পারবে না। যেমন, গণবিপ্লব ঠেকাতে আমেরিকার ব্যাপক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও দেশটির বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিতে পারছে না মিশর সরকার। মিশরে মার্কিন নেতাদের ঘন ঘন সফরই তার প্রমাণ। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট মুরসির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৈঠক করেছেন।  তবে এর অর্থ এই নয় যে, নয়া সরকার সাবেক স্বৈরশাসক মুবারকের মতো পাশ্চাত্য বিশেষ করে আমেরিকার কথায় ওঠবস করবে। বরং বিপ্লবী সরকার আমেরিকার উপর থেকে নির্ভরশীতলতা কমিয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তবে বাস্তবতা হলো, পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে অর্থনৈতিক ইস্যুকে কোন ভাবেই উপেক্ষা করতে পারবে না মিশর সরকার। বিশেষকরে মিশরের জনগণের সঙ্গে অন্যায় আচরণ সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলোর বিষয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে হুট করে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিই অনুসরণ করবে কায়রো। সব মিলিয়ে, মিশরের পররাষ্ট্রনীতিতে শিগগিরই ব্যাপক কোন পরিবর্তন হয়তো লক্ষ্য করা যাবেনা। তবে অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হওয়ার পর দেশটি নিশ্চিতভাবেই তার পররাষ্ট্রনীতিতে বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবে।(রেডিও তেহরান)