হোসাইন কাফেলার উজ্জ্বল নক্ষত্র
হোসাইন কাফেলার উজ্জ্বল নক্ষত্র
0 Vote
213 View
আল্লাহর প্রতি ঈমান, বীরত্ব এবং বিশ্বস্ততার সু-উচ্চ শিখরের দিকে আমরা যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাবো মহান এক ব্যক্তিত্বের নাম জ্বলজ্বল করছে,তিনি আর কেউ নন আলী (আ) এর সুযোগ্য সন্তান আব্বাস। মানবীয় পূর্ণতা ও ফযীলতের দিক থেকে তাঁর নাম ইতিহাসে খ্যাত। বহু মানুষ ধর্মবিশ্বাস,সত্যান্বেষণ এবং সাহসিকতা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন। বর্তমান প্রজন্ম আবুল ফাযলিল আব্বাসের মতো মহান ব্যক্তিত্বের বীরত্বপূর্ণ চেষ্টা-প্রচেষ্টার কাছে ঋণী। আজ আমরা এই মহান মনীষীর জীবন ও কর্ম নিয়ে খানিকটা আলোচনা করবো। এক হাজার চার শ' বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে,আজো আব্বাস ইবনে আলী (আ) এর শৌর্য-বীর্যময় বীরত্বগাথায় ইতিহাসের পাতা অলংকৃত হয়ে আছে। আর তা থেকে সত্যান্বেষী নতুন প্রজন্ম তাদের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। আবুল ফাযল নামে বহুল পরিচিত আব্বাস ইবনে আলী আসলে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে এমন একটি চেরাগ জ্বালিয়ে দিয়েছেন যার আলো মানবিকতা ও আভিজাত্যের দিকে মানুষকে নিরন্তর আহ্বান জানাচ্ছে। তিনি ইবাদাত-বন্দেগি,আধ্যাত্মিকতা ও রাতজাগার ক্ষেত্রে অনেক উচ্চ মর্যাদার একজন ব্যক্তিত্ব। ফাতেমাতুয যাহরা (সা) এর মৃত্যুর পর আলী (আ) এর স্ত্রী ছিলেন ফাতেমা কালাবিয়া। তিনি ছিলেন এক মহিয়সী ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত মহিলা। নবী-পরিবারের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ। নবীজীর আহলে বাইতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও অনুরাগ ছিল কোরআনের বর্ণনার মতো যেখানে নবীজীর রেসালাতের প্রতিদান হিসেবে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার ইঙ্গিত রয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে-বলো! আমি রেসালাতের জন্যে তোমাদের কাছে কোনো পুরস্কার চাই না,তবে একটা জিনিস চাই তাহলো আমার নিকটজনদের প্রতি তোমরা ভালোবাসা পোষণ করবে। তিনি হযরত যাহরা (সা) এর প্রিয়ভাজন হাসান,হোসাইন, যেয়নাব এবং উম্মে কুলসুমের ব্যাপারে মাতৃসুলভ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাদের যথাযোগ্য যতœ নিতেন তিনি। পক্ষান্তরে পূত-পবিত্র ও চরিত্রবান এই মহিয়সী নারী আহলে বাইতের কাছে ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয়। হযরত যেয়নাব (সা) তাঁর সাথে সুখ-দুখের অংশীদার হতেন। হযরত আবুল ফাযল ছিলেন এই সত্য ও ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা পবিত্র অন্তরের অধিকারী নারীর সন্তান। তিনি ছিলেন চার পুত্র সন্তানের জননী। সেজন্যে তাঁকে উম্মুল বানীন বা ছেলেদের মা নামে অভিহিত করা হতো। আব্বাস ছিলেন উম্মুল বানীনের প্রথম সন্তান। তিনি ২৬ হিজরীর ৪ শাবান তারিখে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে আলী (আ) এর ঘর আশার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। আব্বাসের চেহারা ছিল চাঁদের মতো জ্বলজ্বলে। পরবর্তীকালে তাঁর চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের সহযোগে তিনি বনী-হাশেমের চাঁদ উপাধি লাভ করেছিলেন। আলী ইবনে আবি তালেবের মতো পিতা থাকায় পারিবারিক সম্মান মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিলেন তাঁরা এবং সেইসাথে আলী (আ) এর চিন্তাদর্শের ঝর্ণাধারায় সমৃদ্ধ হন। ইমাম আলী (আ) এর বিশেষ প্র্র্রশিক্ষণ আব্বাসের জীবনে বা তাঁর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আলী (আ) আব্বাসকে কৃষিকাজ,মনোদৈহিক শক্তি বৃদ্ধি,তীরন্দাযি,তলোয়ার চালনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সেজন্যে আব্বাস কখনো কৃষিকাজ করেছেন,কখনো বা মানুষকে হাদীস এবং ইসলামী শিক্ষা দিয়েছেন এবং সর্বাবস্থায় পিতার মতো দুর্বল অসহায়দের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আব্বাসের আরেকটি চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ছিল শিষ্টাচার বা রীতিনীতি মেনে চলা। আলী (আ) তাঁর সন্তানের উদ্দেশ্যে বলেছেন-হে আমার সন্তান! শিষ্টাচার হলো জ্ঞান-বুদ্ধির পক্কতা এবং অন্তরের জাগৃতির কারণ আর ফযিলত ও মূল্যবোধের সারাৎসার। অন্যত্র তিনি বলেছেন-শিষ্টাচারের চেয়ে মূল্যবান আর কোনো উত্তরাধিকার নেই। হযরত আলী (আ) এর শাহাদাতের পর হযরত আব্বাস তাঁর সর্বশক্তি ও সামর্থ দিয়ে নিজ ভাই ইমাম হাসান এবং ইমাম হোসাইনকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসছিলেন। কোনোভাবেই তিনি তাঁদের তুলনায় নিজেকে অগ্রবর্তী ভাবেন নি কিংবা তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে কিছুতেই তিনি পিছপা হন নি। তাঁর বীরত্বের বিষয়টি বহুক্ষেত্রেই ইমাম আলী (আ) এর কথা স্মরণ করিয়ে দিতো। ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর পিতার সাথে ভয়াবহ যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইসলাম রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক আশূরা বিপ্লবেও ইমাম হোসাইন (আ) এর কাফেলার অগ্রবর্তী সৈনিক ছিলেন তিনি। আশুরার দিনে হযরত আব্বাস অন্য ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ "আজ এমন এক দিন যেদিন আমাদের উচিত বেহেশতকেই বেছে নেওয়া এবং আমাদের নেতা ও ইমামের পথে আত্মোৎসর্গ করা। হে ভাইয়েরা! এমনটি ভেবো না যে,হোসাইন আমাদের ভাই এবং আমরা একই পিতার সন্তান। না,তেমনটি নয়। বরং তিনি হলেন আমাদের নেতা, আল্লাহর যমিনে তাঁরই হুজ্জাত। একইভাবে মহানবীর প্রিয় কন্যা ফাতেমা (সা) এর সন্তান। " যখন উমাইয়া শাসক ইয়াযিদের সেনারা ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সাথীদের ঘিরে ফেললো,সেই ৬১ হিজরীর মুহররম মাসের সপ্তম দিনে শত্রুদের সারিকে আব্বাস দমন করেছিলেন এবং ইমামের বাহিনীর তৃষ্ণার্তদের জণ্যে পানি নিয়ে এসেছিলেন। তিন দিন পর আশুরার দিনেও ইয়াযিদি বাহিনী ইমামের সঙ্গীসাথীদের ঘিরে ফেললে পুনরায় বীরবিক্রমের সাথে তিনি পানির উৎস ফোরাতে গিয়েছিলেন ইমামের সন্তান এবং তাঁর বাহিনীর জন্যে পানি আনতে। এ সময় তিনি যে কালজয়ী আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আজীবন। আব্বাস নিজেও ছিলেন ভীষণ তৃষ্ণার্ত। তিনি আঁজলা ভরে যখন পানি নিলেন খাবার জন্যে হঠাৎ ইমামের সন্তানদের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল,তিনি আর পানি খেতে পারলেন না। ফোরাত থেকে ফিরে আসার পথেই তিনি নির্মমভাবে শহীদ হন। শহীদ হবার পর তাঁর পবিত্র দেহটি যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তখন ইমাম হোসাইন (আ) অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আব্বাসের মাথাটি কোলে নিয়ে বলেছিলেন-প্রিয় ভাই আমার! তুমি যেভাবে পরিপূর্ণভাবে জেহাদ করেছো আল্লাহ তোমাকে সর্বোত্তম পুরস্কার দিন।