ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে একটি আদর্শ সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য

ইমাম আলী (আ) একজন উচ্চ মর্যাদাবান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মানব সমাজের একজন বড়ো চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সুনির্দিষ্ট ও সুপ্রযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তিনি তাঁর অসামান্য জ্ঞানের ভিত্তিতে সঠিক ও সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ন্যায় ও কল্যাণময় সমাজ বিনির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন যদিও তিনি তা বাস্তবায়ন করার মতো যথেষ্ট সময় পান নি। তবে তাঁর সেই সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নজিরবিহীন একটি আদর্শ হিসেবে আজো বর্তমান রয়েছে।

ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে একটি আদর্শ সমাজের প্রথম বৈশিষ্ট্যটি হলো আদর্শ সমাজের কাঠামো বিনির্মিত হতে হবে একত্ববাদ এবং আল্লাহর বন্দেগির ওপর ভিত্তি করে। সমাজের শাসকশ্রেণী নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা বা উপদেশ হলো তারা যেন নিজেদের এবং নিজেদের খোদার জন্যে সর্বোত্তম সময়টুকু নির্বাচন করেন এবং তারপর জনগণের হাতে হাত মিলিয়ে সমাজে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর অধীনস্থ গভর্নরদেরকে প্রায়ই সতর্ক করে চিঠি দিতেন। সেসব চিঠি নাহজুল বালাগা নামক সংকলনে বিধৃত রয়েছে।

হযরত আলী (আ) যে সফল সমাজে শাসন করেছিলেন,সেখানে জনগণ এবং চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীগণ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালিয়েছিলেন।কোনোক্রমেই নিজেদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তারা উদাসীন ছিলেন না। তারা আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ছিলেন পরস্পরে ঐক্যবদ্ধ ও সহযোগী। আলী (আ) তাঁর এক প্রতিনিধিকে বলেছিলেন মানুষকে এতো বেশি ভালোবাসবে,একজন বাবা বা মা তার সন্তানদেরকে যতোটা ভালোবাসে। তিনি তাঁর এক সঙ্গীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেনঃ তুমি তো তাদেরই একজন দ্বীনের ব্যাপারে সাহায্যকারীদের মধ্য থেকে যাদের কাছ থেকে আমি সহযোগিতা নেই এবং যেসব গুনাহগারদের ঔদ্ধত্য ও অহংকারকে গুঁড়িয়ে দেই। অতএব সকল সমস্যায় আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করো। খিটমিটে স্বভাবকে নম্র করো। যেখানে আপোষ করা ভালো মনে করো,সেখানে তাই করো। আর যেখানে সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না সেখানে আঙ্গুল বাঁকা করো।নাগরিকদের সামনে তোমার পাখা-পালক মেলে ধরো। চোখের দৃষ্টি এবং ইশারাতেও মানুষের সাথে বিনয়ী হও। সালাম করার ক্ষেত্রে কিংবা ইশারা করার ক্ষেত্রে সবার সাথে সমান আচরণ করো যাতে বলদর্পীরা তোমাকে বিরক্ত করার সুযোগ না পায় আর অক্ষম অসহায়গণ তোমার ন্যায়নীতির ব্যাপারে নিরাশ না হয়।

নাহজুল বালাগায় বর্ণিত সমাজ এবং হুকুমাতের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো সমাজের জনগণের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করা এবং মতবিনিময় করা। ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে সমাজ পরিচালনার ব্যাপারে সর্বোত্তম ও সঠিক উপায়গুলো খুঁজে পাবার জন্যে ভুলভ্রান্তিগুলো এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। একটি সমাজের বিকাশের ব্যাপারে আলী (আ) বলেছেনঃ পরামর্শের চেয়ে উত্তম আর কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই। যারা জনমত এবং বিচিত্ররকম দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানায়,তারা ভুল থেকে শুদ্ধটাকে ভালোভাবেই আলাদা করে নিতে পারে।

একটা সমাজকে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে হলে সেই সমাজের ভ্রান্ত মূল্যবোধ ও আচার-প্রথায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং দৃষ্টিভঙ্গি আর সচেতনতা সে সমাজের স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হতে হবে। যে সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসর,সেই সমাজ অন্যদের ক্রীড়নক বা হাতিয়ারে পরিনত হয়।আর যতোই জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধির উন্নতি হবে সে সমাজের লোকজনকে সুবিধাবাদীরা তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহার করতে পারবে। আলী (আ) তাই সমাজ থেকে সকল অসৎ ও অপসংস্কৃতির বিলোপ ঘটানোর ব্যাপারে চূড়ান্তরকম পক্ষপাতী। জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেনঃ আত্মনিমগ্নতার আগে এবং জ্ঞানের উৎস ও জ্ঞানী লোকদেরকে হারানোর আগেই তাড়াতাড়ি জ্ঞান অর্জনের পথে এগিয়ে যাও। বিশ্বের বহু দেশের পশ্চাদপদতার অন্যতম একটি কারণ হলো তোষামোদবৃত্তি। তোষামোদবৃত্তি রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং নেতাদের দুর্নীতির কারণ। তোষামোদের কারণে ভালো-মন্দ বিচার করার দিকটি বিবেচনায় আনা হয় না। অযোগ্য ব্যক্তিও তোষামোদের কারণে যোগ্যতার মানদণ্ডে বিচার্য হয়ে ওঠে। হযরত আলী (আ) তাঁর একজন প্রতিনিধির উদ্দেশ্যে বলেছিলেনঃ কখনোই আত্মপূজারী হবে না,নিজের ভালোত্বের ব্যাপারে আত্মতুষ্টি লাভ করো না,কখনোই প্রশংসা ভালোবেসা না। কেননা এইসবই তোমাকে পতনের অতলে নিয়ে যাবার জন্যে এবং তোমার সকল নেক আমলকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে শয়তানের সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার।

আলী (আ) সিফফিনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটা লোক তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করছিলো। আলী (আ) তখন বললেন,তোমরা হয়তো ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো যে আমি হয়তো প্রশংসা পছন্দ করি কিংবা প্রশংসা আশা করি। আল্লাহর অসীম কৃপায় আমি প্রশংসা বা চাটুকারিতা পছন্দ করি না। আমি বরং সেটাই বেশি ভালোবাসি যা ভালোবাসেন আল্লাহ তায়ালা।(সূত্র: ইন্টারনেট)