ইমাম আলী (আ) এর দৃষ্টিতে পরহেজগার লোকদের স্বরূপ

পরহেজগারী এমন একটা বিষয় যে ব্যাপারে আল্লাহর সকল নবী-রাসূলই মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কোরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো মানুষের পারস্পরিক সম্মান-মর্যাদার উচ্চতর উৎস হলো একমাত্র পরহেজগারী। আলী (আ)ও নাহজুল বালাগায় পরহেজগারীর মতো আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের শ্রেষ্ঠ এই মাধ্যমটি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি সবসময়ই আল্লাহর নাম নিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেছেন। এক বতৃতায় তিনি বলেন আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতের জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।আল্লাহ রঅধিকার আদায়ে তাঁর কাছ থেকেই সাহায্য প্রার্থনা করি। আল্লাহ হলেন মহান এবং সর্বশক্তিমান। তাঁর সিপাহীরা অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই আল্লাহকে ভয় করো এবং তাকওয়াবান হও।

মানুষ যদি তার অভ্যন্তরে আত্মিক এবং আধ্যাত্মিকতা অবস্থাকে লালন করে এবং আভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর অভিজ্ঞ হয়,তাহলে সে যে কেবল গুনাহর দিকেই ধাবিত হবে না-তাই নয়,বরং তার নিজের ওপর যে আত্মনিয়ন্ত্রণ রয়েছে,সেই শক্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং সেই শক্তি আত্মাকে শক্তি যোগায়।আর এই শক্তিটাই হলো পরহেজগারী। আলী (আ) সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ হে আল্লাহর বান্দারা! তোমাদের আল্লাহর তাকওয়ার দিকে আহ্বান জানাই। তাকওয়া হলো কিয়ামতের সফরের পাথেয়। পরহেজগারী এমন এক পাথেয় যা মানুষকে তার মঞ্জিলে মকসুদে অর্থাৎ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে নিয়ে যায়। তাকওয়া এমন এক আশ্রয়স্থল যেখানে সবাই নিরাপদ।

অনেকে মনে করেন যে তাকওয়া বোধ হয় নির্দিষ্ট একটা শ্রেণীর মানুষের জণ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ প্রকৃত সত্য হলো পরহেজগারী হলো ব্যক্তির সৌভাগ্যবান হবার নেপথ্য শক্তি। পরহেজগারী মানুষকে ক্ষণিকের ভোগ-বিলাস থেকে দূরে রাখে যাতে সে তার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে। সে একধরনের ছাত্রের মতো যে কিনা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে তার বহু ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দেয়। জ্ঞানান্বেষি যদিও নিজেকে কিছু কিছু জিনিসের মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলে এবং সর্বান্তকরণে সে বেশি বেশি জানার পেছনেই পড়ে থাকে। তার এই সীমাবদ্ধতা কিন্তু তারি নিজস্ব উন্নতির সোপান।

ব্যাপারটা এমন যে,তাকওয়াবান মানুষকে সুস্থ চিন্তা ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যের অধিকারী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয়। আলী (আ) এর ভাষায় নফসের লাগাম তার নিজ হাতে রয়েছে। এ কারণে আলী (আ) পরহেজগারীকে নফসের সম্মান ও মুক্তির কারণ বলে মনে করেন। নাহজুল বালাগায় তিনি বলেছেনঃ তাকওয়া হলো কিয়ামতের যথার্থ সঞ্চয় এবং উপযুক্ত চাবি। সর্বপ্রকার গোলামি থেকে মুক্তির উপায়। সকল প্রকার দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির পথ। তাকওয়ার মাধ্যমে মানুষ তার নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে , শত্রু থেকে রেহাই পায় এবং নিজস্ব ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবায়িত করতে পারে।

পরহেজগারী মানুষের অন্তরাত্মায় পুণ্য ও কল্যাণকামী চিন্তার বিকাশ ঘটায়। আলী (আ) এর মতে যাঁরা এই পথে পা ফেলেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। কেননা নাহজুল বালাগার বিভিন্ন স্থানে আমরা আমিরুল মুমেনিনের আহ্বান লক্ষ্য করবো। তিনি চেয়েছেন,মানুষ নিজেকে পরহেজগারীর আলোকে সমৃদ্ধ করুক। অন্তরকে যেন তারা পরহেজগারীর চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। তিনি বলেছেন পরহেজগার ব্যক্তিকে সমাজে উচ্চ মর্যাদাবান ও সম্মানীয় মনে করতে হবে। কেননা তাঁরা কল্যাণ ও বিনয়ের পথ অতিক্রম করে।

আলী (আ) বলেছেন,পরহেজগারীর বিষয়টি মনে রেখো!পার্থিব জগত থেকে পবিত্র থেকো। পরকালীন সাক্ষাতের ব্যাপারে আকর্ষণ বোধ করো। যারা তাকওয়া অর্জনের মধ্য দিয়ে উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয়েছে,তাদেরকে হীন মনে করো না। আর দুনিয়া যাদেরকে উচ্চাসনে স্থাপিত করেছে তাদেরকে উচ্চ মর্যাদাবান ভেবো না। অন্যত্র তিনি মুত্তাকিনদের বাহ্যিক আকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন এবং তাওকয়া ও পরহেজগারীর সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছেন।

 নাহজুল বালাগায় আলী (আ) বহুবার মুমিনের বৈশিষ্ট্য বা স্বরূপ এঁকেছেন। একইভাবে মোত্তাকিনদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেছেন। হাম্মাম নামে একজন পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন। একদিন তিনি হযরত আলী (আ) এর খেদমতে হাজির হয়ে বললো,হে আমিরুল মোমেনিন! আপনি মোত্তাকিনদের কথা এমনভাবে বর্ণনা করুন যাতে মনে হয় আমি তাদের দেখছি। হযরত খানিক কালক্ষেপণ করে বললেনঃ হে হাম্মাম! তুমি নিজে খোদাকে ভয় করো এবং ভালো কাজ করো। খোদা পরহেজগার এবং পুণ্যবানদের সাথে রয়েছেন। কিন্তু হাম্মাম এই উত্তরে তুষ্ট বা পরিতৃপ্ত হলো না,সে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাইলো। তাদের বসবাস পদ্ধতি,তাদের ইবাদাত-বন্দেগির পদ্ধতি এবং তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলো। তখন ইমাম আলী (আ) মুমিনদের বৈশিষ্ট্য এবং মুত্তাকিনদের স্বরূপ সম্পর্কে শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক বর্ণনা করেন।

আলী (আ) এর বক্তব্যে মুমিন এবং মুত্তাকি ব্যক্তিরা জ্ঞানী এবং মর্যাদাবান। তাঁরা সত্য ব্যতিত অন্য কিছু বলেন না,তাঁদের মাঝে উগ্রতা নেই,তারা ভারসাম্যপূর্ণ এবং মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। আল্লাহ যেসব বস্তু মানুষের জন্যে হারাম করেছেন সেসবের ওপর থেকে তাদের দৃষ্টি ফেরানো। উত্তম ও ফযিলতপূর্ণ ভাষণের দিকে তাঁদের কান সবসময় পাতা থাকে। আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি তারা এতোটাই অনুগত যে আনন্দ-বেদনা তাদের কাছে এক সমান। দেহ কাঠামোটা তাদের আত্মার জন্যে একটা ছোট খাঁচার মতো। মৃত্যু যদি তাদের জন্যে নির্ধারিত না হয়ে থাকতো তাহলে তারা ঐ খাঁচাটিকে এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য করতো না। সওয়াবের আশায় এবং শাস্তির ভয়ে তারা প্রাণ দিয়ে দেয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এ সম্পর্কে বলেছেনঃ ধর্মীয় ব্যক্তিরা নিজেদের অস্তিত্বকে এক ধরনের কারাগারে আবদ্ধ বলে ভাবে। তারা চায় দেহের খাঁচা থেকে উড়াল দিতে এবং সমস্ত অস্তিত্বকে একবারে একটি ইউনিট হিসেবে পেতে। অবশ্য আলী (আ) এর বক্তব্যে এই সত্যটি আরো বিস্তারিত এবং পরিপূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর দৃষ্টিতে মুমিন ব্যক্তি জানে যে সত্ত্বার একটি অংশের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে কেননা সমগ্র সত্ত্বা হলো বিশাল সমুদ্রের মতো অসীম। সেজন্যেই তারা হঠাৎ কাঠামো ভেঙ্গে তাদের অন্তরকে মুক্তি দেয়। হাম্মাম সংক্রান্ত ইমাম আলীর ভাষণেও এ বিষয়টি এসেছে। যখন পরহেজগারদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা সম্পর্কে ইমামের বক্তব্য শেষ হয় হাম্মাম তখন চিৎকার করে ওঠে এবং মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

যে ব্যক্তি তার চিন্তাকে পার্থিব জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না করে এই বিশ্বের কোনো উৎকণ্ঠা তার নেই এবং যাই সে করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই করে,তার এই মানসিক প্রশান্তি অদৃশ্যের প্রতি তার ঈমান এবং পরকালের প্রতি তাঁর বিশ্বাস থেকেই উদ্ভুত। আমরা বরং আলী (আ) এর বক্তব্যের প্রতিই মনোযোগ দিই। পরেহজগারগণ রাতের বেলা নামাযে দাঁড়ান কোরআন পড়েন,মুখস্ত করেন,অন্তরে বেদনা দূর করার ঔষধ তাঁরা কোরআনে অন্বেষণ করেন। যখন বেহেশতের বর্ণনা সংবলিত আয়াত সামনে আসে তখন তাদের সামনে বেহেশতের চিত্র এমনভাবে ফুটে ওঠে যেন মনে হয় বেহেশতের নিয়ামতগুলো তারা তাদের সামনে দেখতে পাচ্ছে। আর যখন দোযখের আযাবের আয়াত সামনে আসে তখন মনে হয় তারা যেন তা প্রত্যক্ষ করছে,তাই দ্রুত তারা রুকু-সিজদায় গিয়ে আল্লাহর দরবারে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি কামনা করে। কিন্তু দিনের বেলায় পরহেজগারদের দেখবে ভীষণ নম্র,ভদ্র ও সহনশীল। তারা তাদের জ্ঞান এবং তাকওয়ার মাধ্যমে পুণ্য কাজ করে। আল্লাহর ভয় তাদেরকে ধনুকের মতো বাঁকা করে ফেলেছে। যারা তাদের দিকে তাকায় ভাবে তারা অসুস্থ আসলে তাদের কোনো রোগ নেই। আলী (আ) পরহেজগারদের নৈতিক গুণাবলি সম্পর্কে আরো বলেনঃ পরহেজগারদের নিদর্শন হলো তাঁরা ভীষণ দ্বীনদার,নম্র-ভদ্র,দূরদর্শী চিন্তার অধিকারী,দৃঢ় ঈমানদার,জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে লোভী, সহনশীল জ্ঞানী,সম্পদের ব্যাপারে মিতব্যয়ী,ইবাদাতের ক্ষেত্রে বিনয়ী,দারিদ্র্যে সজ্জিত,কষ্ট সহিষ্ণু,হালালের সন্ধানে থাকা,হেদায়েতের পথে প্রফুল্ল আর লোভ-লালসা পরিত্যাগী।

পাঠক! ইমাম আলী (আ) এর ভাষণটি বেশ দীর্ঘ হবার কারণে সংক্ষিপ্ত পরিসরের উপস্থাপন করা হল। আপনারা যারা ইমাম আলী (আ) এর ভাষণটি পুরোপুরি শুনতে বা পড়তে চান তাঁরা নাহজুল বালাগার ১৯৩ নম্বর ভাষণটি পড়তে পারেন। এ ভাষণটিকে খুৎবায়ে হাম্মাম বা খুৎবায়ে মুত্তাকিন বলা হয়। আল্লাহ আমাদেরকেও তাকওয়াবানদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত করুন । (সূত্র: ইন্টারনেট)