মৃত্যুর স্বাদ

মৃত্যু অর্থাৎ দেহ থেকে রুহের পৃথক হওয়া এবং আলামে বারযাখে প্রবেশ করা। মৃত্যুর অপর একটি রূপ হচ্ছে নবজন্মগ্রহণ। জন্ম যা প্রথম পর্যায়ে মানুষের অধিনে নাই তারা জানে না যে সে কোন স্থানে, কোন পরিবারে জন্মগ্রহণ করবে সুস্থ জন্মগ্রহণ করবে নাকি অসুস্থ জন্মগ্রহণ করবে। কিন্তু মানুষের পরের জন্ম হচ্ছে মানুষের অধিনে যে, সে জান্নাতী হবে নাকি জাহান্নামী। আমরা যদি কোরআনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাব যে, কোরআনে বলা হয়েছেঃ كلُ‏ُّ نَفْسٍ ذَائقَةُ المَْوْت প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৮৫) أَيْنَمَا تَكُونُواْ يُدْرِككُّمُ الْمَوْتُ وَ لَوْ كُنتُمْ فىِ بُرُوجٍ مُّشَيَّدَة তোমরা যেখানেই থাক না কেন;মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর,তবুও। (সূরা নিসা, আয়াত নং ৭৮) আমরা হজরত আলী (আ.) এর একটি রেওয়ায়েতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে, যেখানে তিনি মৃত্যু সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। তিনি হজরত সুলাইমান সম্পর্কে বলেছেন যে, হজরত সুলাইমান (আ.) যাকে খোদা মানুষ এবং জ্বিন জাতীর উপরে ক্ষমতা দান করেছিলেন তাকেও মৃত্যু অস্বাদন করতে হয়েছিল। হজরত সালমান যিনি ছিলেন রাসুল (সা.) এর একজন একনিষ্ঠ সাহাবী এবং আহলে বাইত (আ.) এর প্রিয়ভাজন ছিলেন। তিনি হজরত ফাতেমা (সা.আ.) এর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি ইমাম মাহদী (আ.) এর যুগে রাজআত করবেন। একদা তিনি একজন মৃত ব্যাক্তির সাথে কথা বলেন এবং ইসলামে যে সালমানের এত সম্মান ও মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে সে সালমান মৃত্যুর অবস্থা শুনে জারেজারে ক্রন্দন করেন। নিন্মোক্ত রেওয়ায়েতে তাঁর সাথে একজন মৃত ব্যাক্তির মৃত্যুর স্বাদ সম্পর্কে কথোপকথোন হয়। আসবাগ বিন নোবাতে বলেনঃ যে একবার সালমান অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন সে বলে রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন যে হে সালমান! মৃত্যুর পূর্বে যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে তখন খোদার বিশেষ কৃপায় তুমি একজন মৃত ব্যাক্তির সাথে কথা বলবে। উক্ত ঘটনাটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষামূলক ঘটনা যার বাহানায় আমরা মৃত্যুকে স্মরণ করতে পারবো। সালমান আসবাগ বিন নোবাতে কে বলেনঃ আমার জন্য একটি খাটিয়া যোগাড় কর এবং আমাকে তাতে রেখে মৃত ব্যাক্তির ন্যায় কবরস্থানে নিয়ে চল। আসবাগ বিন নোবাতে তাকে কবরস্থানে নিয়ে যায়। তিনি মৃত ব্যাক্তিদের সালাম দেয়া শুরু করেন এবং বলেনঃ সালাম হোক হে বালা মুসিবতের অধিবাসীরা। সালাম হোক তোমাদের উপরে যারা পৃথিবীবাসীর চক্ষুরঅন্তরালে অবস্থান করছো। সালাম হোক তোমাদের উপরে যারা অপ্রিয় মৃত্যুকে আস্বাদন করেছ। সালাম হোক তোমাদের উপরে যারা মাটির নিচে শুয়ে আছ। সালাম হোক তোমাদের উপরে যারা পৃথিবীতে তোমাদের কৃত আমলের পরিণামের সাথে সাক্ষাত করেছ। সালাম হোক তোমাদের উপরে যারা কেয়ামতের প্রথম ফুৎকারের অপেক্ষায় রয়েছ। তোমাদের কসম দিচ্ছি মহান আল্লাহ তায়ালার এবং হজরত মোহাম্মাদ (সা.) এর তোমাদের মধ্যে থেকে কেউ আমার কথা জবাব দাও। কেননা আমি হচ্ছি রাসুল (সা.) এর একজন আযাদকৃত ব্যাক্তি। তিনি আমাকে বলেছিলেনঃ হে সালমান যখন তোমার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসবে তখন মৃতব্যাক্তি তোমার সাথে কথা বলবে। আমি জানতে চাই যে, আমার মৃত্যুর সময় সন্নিকটে কিনা? আসবাগ বলেনঃ যখন হজরত সালমান (রা.) এর কথা শেষ হয় তখন হঠাৎ এক কবরবাসী কথা বলেঃ সালাম হোক তোমার উপরে যে দুনিয়াতে নিজের ঘর বানিয়েছ অথচ তুমি নিজেই এ দুনিয়াতে চীরস্থায়ী না, তুমি আখেরাতকে ভুলে দুনিয়ার কাজে ব্যাস্ত রয়েছ। আমরা তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি এবং তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। তোমার উপরে রহমত হোক কি জানতে চাও জিজ্ঞাসা কর সালমান বলেঃ তুমি যে, মৃত্যুর মতো অবাঞ্চিত সত্যর পরেও কথা বলছো তুমি কি বেহেস্তবাসী নাকি জাহান্নামবাসী? অতপর মৃত ব্যাক্তি বলেঃ হে সালমান! আমি হচ্ছি সে ব্যাক্তি যাকে খোদা তার অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন এবং তার ক্ষমাসুলভ গুণে এবং রহমতের কারণে আমাকে বেহেস্ত দান করেছেন। অতপর সালমান বলেনঃ হে ব্যাক্তি যেহেতু তুমি বেহেস্তে অবস্থান করছো আমাকে মৃত্যু সম্পর্কে অবগত কর। আমাকে বল কিভাবে তোমর মৃত্যু হয় এবং তার পরে তুমি কার সাথে সাক্ষাত করেছ এবং কি কি দেখেছ? মৃত ব্যাক্তিটি বলেঃ হে সালামান! তুমি জানতে চাও খোদার শপথ মৃত্যুর সময়ের অবস্থার চেয়ে মানুষকে কেচি বা করাত দিয়ে কাটার কষ্ট সহ্য করা অনেক সহজ। হে সালমান! শুন আমি এমন একজন ব্যাক্তি যাকে খোদা ভাল অবস্থান দান করেছে। আমি সর্বদা ভাল কাজ করতাম, খোদার নির্দেশাবলির উপরে আমল করতাম, খোদার কিতাবের তেলাওয়াত করতাম, আমার পিতামাতার খেদমত করতাম, অত্যাচার করা, হারাম এবং কারো কাছে হাত পাতা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলাম হালাল অর্জনের জন্য চেষ্টা করতাম। আমি যখন সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করছিলাম তখন হঠাৎ আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং কয়েকদিন অসুস্থ থাকার পরে আমি মৃত্যুর সম্মুখিন হই। আমি দেখি যে, একজন বিশাল আকারের ভয়ঙ্কর ব্যাক্তি না আকাশের দিকে উর্দ্ধমান ছিল আর না মাটিতে অবস্থান করছিল সে আমার সামনে এসে উপস্থিত হয় এবং সে আমার চোখের দিকে ইশারা করলে আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি, আমার কানের দিকে ইশারা করলে আমি শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলি এবং আমার জিহ্বার দিকে ইশারা করলে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলি এবং তখন আমি অন্ধ, বধির এবং শ্রবণশক্তিহারা একজন ব্যাক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি যে তুমি কে যে, আমাকে আমার মাল সম্পদ, সন্তান সন্ততি থেকে আমাকে আলাদা করে দিতে চাও?। সে বলেঃ আমি মালেকুল মউত তোমাকে দুনিয়া থেকে আখেরাতে নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার সময় শেষ হয়ে গেছে এবং তুমি অন্তিম সময়ে অবস্থান করছো আমি তার সাথে এ কথায় বলছিলাম যে, সে আমার রূহ কবজ করা শুরু করে এবং আমি এমন অনুভব এ আগে কখনও করিনি। মনে হচ্ছিল যেন আকাশ মাটির উপরে ভেঙ্গে পড়ছে। সে আমার রূহকে আমার বুক পর্যন্ত টেনে আনে। হঠাৎ সে আমার দিকে ইশারা করে এবং এবং মনে হচ্ছিল যেন যদি সে ইশারা দ্বারা সে কোন পাহাড়কে ইশারা করতো তাহলে তাহলে সে পাহাড়ও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত এবং এভাবে সে আমার চোখ দ্বারা আমার রূহকে কবজ করে। আমি তখন আমার পরিবারের লোকজনের ক্রন্দনের আওয়াজ শুনতে পাই। তখন আমি না কিছু করতে আর না কিছু বলতে পারছিলাম শুধুমাত্র অসহায়ের ন্যায় তাকিয়ে দেখছিলাম। সুতরাং যখন আমার গোত্রের লোকেরা আমার জন্য ক্রন্দন করছিল তখন মালেকুল মউত তাদের প্রতি ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখছিল এবং বলছিল যে, কেন তোমরা ক্রন্দন করছো। শপথ খোদার যে আমি তার উপরে কোন অত্যাচার করিনি যে তোমরা অভিযোগ করছ, তার সাথে আমার কোন শত্রুতা ছিল না যে তোমরা আহাজারি করছো, বরং আমি এবং তোমরা হচ্ছি একই খোদার বান্দা। যদি তোমাদেরকে আমার রূহ কবজ করার নির্দেশ দান করা হতো তাহলে তোমরাও তাই করতে। তোমরা মনে কর যে আমি তার রূহকে কবজ করিনি বরং তার পৃথিবীর রুজি শেষ হয়ে গেছিল এবং সে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌছে গেছিল। খোদা হচ্ছেন কারিম যা হক্ব তিনি তাই তিনি করেন এবং তিনি সব কিছুর উপরে ক্ষমতা রাখেন। সুতরাং তোমরা ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে সওয়াব অর্জন কর। যদি তোমরা ক্রন্দন কর তাহলে আবার আমি তোমাদের কাছে ফিরে আসব তোমাদের পিতামাতাকে এবং তোমাদের সন্তান সন্তানাদির রূহ কবজ করব। তারপর মালেকুল মউত আমার মৃত দেহর কাছ থেকে যাওয়ার সময় আমার রূহকে তার সাথে নিয়ে যায়। তারপর আরো একজন ফেরেস্তা আসে এবং আমার রূহকে তার কাছ থেকে নিয়ে একটি রেশমী কাপড়ে পেচিয়ে তার সাথে উপরে নিয়ে যায় আমাকে খোদার সমীপে উপস্থিত করে। তখন খোদার পক্ষ থেকে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, কেন তুমি খোদার দানকৃত রূহকে কবিরা এবং সগিরা গুনাহতে লিপ্ত করেছিলে? কেন নামাজ, রোজা, কোরআন তেলাওয়াত, যাকাত প্রদান করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলে। কেন নিজ দায়িত্ব যেমন পিতামাতার অনুসরণ, বিভিন্ন দিন এবং সময়ের অপব্যাবহার করেছিলে, কেন ইয়াতিমের মাল খেয়েছিলে , রাতের অন্ধকারে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকতো তখন কেন তুমি খোদার ইবাদত করনি? উক্ত প্রশ্নগুলো করার পরে আমার রূহকে দুনিয়ার বুকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তখন আমি দেখি যে মৃতকে গোসল দানকারী ব্যাক্তি আমার কাছে আসে এবং আমার শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলে তখন আমার রূহ তাকে বলেঃ হে ব্যাক্তি! তোমাকে খোদার শপথ দিচ্ছি যে আমার সাথে কোমল ব্যাবহার কর কেননা আমার সারা শরীর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে, আমার রগগুলো এবং আমার শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিড়ে গেছে। যদি মৃতকে গোসলদানকারী ব্যাক্তি আমার এ আর্তনাদকে শুনতে পারতো তাহলে সে আর কখনও কোন মৃতকে গোসল দিত না। তারপর উক্ত ব্যাক্তি আমাকে তিন প্রকার পানি দিয়ে গোসল দেয় এবং আমাকে কাফনের তিনটি কাপড় দ্বারা আচ্ছাদিত করে এবং হুনুত করে এই ছিল আমার দুনিয়ার সম্পদ যা আমি দুনিয়া থেকে আখোরাতের জন্য নিয়ে আসি। তারপর সে ব্যাক্তি আমাকে গোসল দেয়ার পরে আমার ডান হাতের আংটি আমার বড় সন্তানকে দিয়ে বলেঃ যে খোদা যেন তোমাকে এই কষ্টে ধৈর্য ধারণের সওয়াব দান করেন। তারপর আমার লাশের কাছে তালক্বিন (তৌহিদ, নবুওয়াত, ইমামত এবং কেয়ামত সম্পর্কে স্বীকারোক্তি নেয়া)পাঠ করা হয় এবং বলে যে সবাই তাকে শেষবারের ন্যায় দেখে নাও কেননা এরপরে তোমরা তাকে আর দেখতে পারবে না। সুতরাং সবাই আমাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য আসে এবং আমাকে বিদায় জানায়। তারপর যখন তারা আমার লাশকে একটি খাটিয়াতে রাখে তখন আমার রূহ আমার দেহ ও কাফনের মাঝে অবস্থান করছিল। আমার দেহকে তারা মসজিদে নিয়ে যায় এবং আমার ‍উপরে জানাযার নামাজ পড়ে এবং আমাকে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যায়। যখন আমাকে কবরের মধ্যে রাখে তখন আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। হে সালমান! মনে হচ্ছিল যেন আমাকে আকাশ থেকে মাটির বুকে ফেলে দেয়া হয়েছে। তারপর আমার লাশকে ঢেকে তার উপরে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। যখন আমার লোকজন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যে, হায়! যদি আমিও খোদার একনিষ্ঠ বান্দাদের মধ্যে একজন হতে পারতাম। তখন আমার রূহ আমার দেহের কাছে আসে, মনে হচ্ছিল যেন আমি শুনতে এবং দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ আমি একজনের আওয়াজ শুনতে পাই। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি তুমি কে যে আমার সাথে কথা বলছ? সে জবাবে বলে আমি খোদার একজন ফেরেস্তা আমার নাম মোনাব্বে, খোদা আমাকে মৃত ব্যাক্তিদের উকিল হিসেবে নিয়োজিত করেছেন যেন আমি তার বান্দার সকল কর্ম সমূহের খোদার সমীপে পৌছায়। তারপর সে আমাকে টেনে তুলে এবং বলে যে, নিজের কৃতকর্ম সমূহ লিখ। আমি বললামঃ আমি তা ভুলে গেছি এবং কিছুই আমার মনে নাই। তখন সে আমাকে বলে তুমি কি শুননি যে খোদা বলেছেনঃ أَحْصاهُ اللَّهُ وَ نَسُوه আল্লাহ তার হিসাব রেখেছেন, আর তারা তা ভুলে গেছে। (সূরা ‍মুজাদেলা, আয়াত নং ৬) তখন সে বলে আমি তোমার কৃতকর্মগুলো বলছি তুমি তা লিখ। আমি বললাম যে আমার কাছে তো কোন কাগজ নাই। তখন সে আমার কাফনের এক কোণা আমার হাতে তুলে দেয় তখন তা কাগজে রূপান্তরিত হয়ে যায় সে বলেঃ এটা হচ্ছে তোমার আমলনামা। আমি তাকে বলি যে আমার কাছে কোন কলম নাই সে বলে তোমার তর্জনি হচ্ছে তোমার কলম। আমি বললাম কালি নাই সে বললো তোমার মুখের লালা হচ্ছে তোমার কালি। তারপর সে আমার সমস্ত সগিরা কবিরা গুনাহ এবং আমি দুনিয়াতে যা কিছু করেছিলাম সে সব কিছুই বর্ণনা করে। খোদা এ সম্পর্কে বলেছেনঃ وَجَدُواْ مَا عَمِلُواْ حَاضِرًا وَ لَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। আপনার পালনকর্তা কারো উপরে জুলুম করবেন না।(সূরা কাহফ, আয়াত নং ৪৯) সব কিছু লিখা হয়ে গেলে সে তাতে সিল মেরে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেয় এবং সে আমলনামা এত ভারী ছিল মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর পাহাড়কে আমার গলাতে ঝুলিয়ে দিয়েছে। তখন আমি সেই মোনাব্বে নামক ফেরেস্তাকে বলি যে কেন তুমি আমার সাথে এমন আচারণ করছো। তখন সে বলে তুমি কি শুননি যে খোদা বলে বলেছেনঃ اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى‏ بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্য তুমিই যথেষ্ট। (সূরা ইসরা, আয়াত নং ১৪) তারপরে সে বলেঃ কেয়ামতে তোমাকে উক্ত আমলনামার সাথে উত্তোলন করা হবে এবং তা তোমার সামনে খোলা হবে যেন তুমি নিজেই তার সাক্ষি দাও। এই কথাগুলো বলে মোনাব্বে নামক ফেরেস্তাটি আমার কাছ থেকে চলে যায়। তারপরে মুনকির নামক ফেরেস্তা আমার কাছে এক আজব চেহারায় উপস্থিত হয় এবং তার হাতে এমন এক ভারী গুরুজ ছিল যা দুনিয়ার সমস্ত জ্বিন এবং মানুষ জাতী চেষ্টা করলেও তা নড়াতে পারতো না। তারপর সে এমন এক আওয়াজ করে যে দুনিয়াবাসী যদি তা শুনতো তাহলে তারা তা শুনেই মারা যেত। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে হে বান্দা তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কি? তোমার নবী কে? তোমার আক্বিদা কি ছিল? তুমি কি সত্যবাদি ছিলে? আমি এই প্রশ্নগুলো শুনে এবং তাকে দেখে ভয় পাই এবং আমার কথা বন্ধ হয়ে যায় আমি বুঝতে পারিনা যে কি বলব। তখন খোদার বিশেষ রহমত আমার উপরে নাযিল হয় আমি স্বাভাবিক হই এবং আমি কথা বলা শুরু করি। হে খোদার সৃষ্টি কেন তুমি আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছ। তখন আমি তার প্রশ্নের জবাবে বলি আমার রব আল্লাহ, নবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.), কিতাব কোরআন, দ্বীন ইসলাম, কিবলা কাবা শরীফ, ইমাম আলী (আ.), আর এটাই হচ্ছে আমার আক্বিদা এবং আমি অবশ্যই কেয়ামতের দিন হজরত মোহাম্মাদ (সা.) এর সাথে সাক্ষাত করব। উক্ত ফেরেস্তাটি কথাগুলো শুনার পরে বলেঃ হে খোদার বান্দা! তোমাকে সুসংবাদ জানাচ্ছি তোমার পরবর্তি জীবনের। এ কথা বলে সে আমার কাছ থেকে চলে যায়। তারপরে নাক্বীর নামক ফেরেস্তা আমার কাছে এমন এক বিকট আওয়াজে আসে যে আওয়াজটি পূর্বের চেয়েও আরো ভয়ানক ছিল। আমি উক্ত আওয়াজটি ‍শুনে আতংঙ্কিত হয়ে যায়। তখ উক্ত ফেরেস্তাটি বলেঃ হে খোদার বান্দা! তোমার আমলনামা নিয়ে আস, আমি তা দেখার এবং শুনার পরে তার জাবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। মহান আল্লাহ যিনি হচ্ছে গাফ্ফার তিনি আমাকে ভয় থেকে পরিত্রাণ দেন। আমি নিজের মধ্যে সস্তি অনুভব করলাম এবং তাকে বললামঃ হে খোদার ফেরেস্তা তুমি আমার প্রতি সহিষ্ণুতা স্বরূপ আচরণ কর কেননা আমি এখনই ইহলোক ত্যাগ করে এসেছি। তারপর আমি ঐ সকল উত্তর যা আমি মুনকির নামক ফেরেস্তাকে দিয়েছিলাম তাকেও সেই উত্তর দিলাম। তখন সে আমাকে সুসংবাদ দিয়ে বলেঃ হে খোদার বান্দা! চেয়ে দেখ ঐ বেহেস্তের প্রতি যা হচ্ছে তোমার স্থায়ী ঠিকানা, আর চেয়ে দেখ ঐ জাহান্নামকে যা থেকে তুমি পরিত্রাণ পেয়েছ। তারপর সে জাহান্নামের রাস্তাকে বন্ধ করে দেয় এবং আমার জন্য জান্নাতের রাস্তাকে উন্মুক্ত করে দেয়, যেন বেহেস্তের বাতাস আমার কবরে আসে আমি বেহেস্তের নেয়ামত সমূহ থেকে উপকৃত হই এবং আমার কবরকে প্রশস্ত করে দেয় এবং বিদায় নিয়ে চলে যায়। হে সালমান! এটাই হচ্ছে আমার মৃত্যুর ঘটনা আমি এত আরামে রয়েছি কিন্তু শপথ হচ্ছে সে খোদার যে মৃত্যুর স্বাদটি কেয়ামত পর্যন্ত আমার গলায় থেকে যাবে। তারপরে সে বলে কবরের প্রশ্নগুলো থেকে ভয় কর এই কথা বলে সে চুপ করে। তারপরে সালমান আকাশের দিকে তাকিয়ে ক্রন্দন করতে শুরু করে এবং বলেঃ হে আল্লাহ তোমার ক্ষমতায় সব কিছুই রয়েছে আমিও তোমার কাছে ফিরে যাব। তিনি সবাইকে নির্দেশ দান করেন কিন্তু কারো কাছ থেকে তিনি নির্দেশ গ্রহণ করেন না। হে খোদা! আমি তোমার নবীর অনুসরণ করেছি, তোমার কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছি, তোমার কৃত ওয়াদা আমার নিকট পৌচেছে (অর্থাৎ আমি মৃত্যুর সম্মুখিন) তুমি ওয়াদার কোন বরখেলাফ হয় না। তুমি আমাকে তোমার কেরামতের ছত্রছায়ায় রেখ। তারপর তিনি কলেমা শাহাদাত বলেন, এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। আসবাগ বলেনঃ আমরা সালমানের মৃত্যুতে মগ্ন হয়ে যায় হঠাৎ লক্ষ্য করি যে, ঘোড়ায় আরোহন করে একজন মুখোশধারী ব্যাক্তি আমাদের কাছে আসেন এবং আমাদেরকে সালাম করেন এবং বলেনঃ হে আসবাগ! সালমান যা বলেছে তার প্রতি আমল কর আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি হচ্ছেন হজরত আলী (আ.)। আমরা সালমানকে গোসল দিতে চাইলে যখন বরই এর পাতা , কফুর নিয়ে আসি তখন হজরত আলী (আ.) বলেন আমার কাছে এগুলো আছে। তিনি নিজেই সালমানকে গোসল দেন, কাফন পরান, কবরে নামান এবং দাফনকার্যাদি সম্পন্ন হলে তিনি বিদায় নিতে চাইলে আমি তার পরিধানের কাপড়ের এক অংশ ধরে জিজ্ঞাসা করি হে আমিরুল মুমিনিন (আ.) আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি যে, হে আলী আমি কি আপনার পরেও জিবীত থাকব? আপনি কিভাবে সালমানের মৃত্যুর খবর জানতে পারলেন এবং কিভাবে এত তাড়াতাড়ি এখানে উপস্থিত হলেন? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেনঃ হে আসবাগ! তুমি যদি আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও যে, এ কথা তুমি কাউকে বলবে না তাহলে আমি তোমাকে তা বলতে পারি। তিনি বললেন হ্যাঁ, তুমি হবে দীর্ঘজিবী তখন আমি তাকে ওয়াদা করে বলি যতদিন আপনি জিবীত থাকবেন আমি এ কথা আর কাউকে বলব না। হজরত আলী (আ.) সালমানের মৃত্যু সম্পর্কে বলেনঃ হে আসবাগ! যখন সালমান মারা যায় তখন রাসুল (সা.) আমার স্বপ্নে আসেন এবং আমাকে বলেনঃ হে আলী সালমান মাদায়েনে মারা গেছে তুমি তার কাফন দাফনের কার্যাদি সম্পাদনের জন্য যাও। তখন আমি মৃত ব্যাক্তির প্রয়োজনীয় জিনীষগুলো সাথে নিয়ে নেই এবং খোদা আমার জন্য পৃথিবীর রাস্তাকে সংকৃর্ণ করে দেন এবং আমি এভাবে মূহুর্তের মধ্যে এখানে চলে আসি। এ কথা বলার পরে তিনি হঠাৎ আমার চোখের অদৃশ্যে চলে যান আমি বুঝতে পারি না যে তিনি কি মাটিতে ঢুকে গেলেন নাকি আকাশে উড়ে গেলেন। উক্ত ঘটনার পরে হজরত আলী (আ.) কুফাতে মাগরিবের নামাজ পড়ান।