হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ)

এমন এক সময় ছিল যখন আরবের সকল মানুষ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এ সময় সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করে যিনি রাসূলের বিপদে-আপদে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিলেন তিনি হলেন উম্মুল মোমেনীন হযরত খাদিজাতুল কোবরা (সাঃ আঃ)। তবে তিনি যে কেবল প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা-ই নয়, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল সবচেয়ে বেশী। হযরত খাদিজা ছিলেন রাসূলে-খোদার প্রথম স্ত্রী। তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের আবির্ভাব নিজ চোখে দেখেছেন। নবীজির উপর ওহী নাজিল হওয়ার পর তিনিই প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। তিনিই প্রথম তাঁর সকল ধনসম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করার ঘোষণা দিয়েছিলেন । হযরত খাদিজাই প্রথম কোন নারী যিনি মক্কার জাহেলী সমাজেও তাহিরা বা পবিত্রা উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন উম্মুল মোমেনীন হযরত খাদিজা (সাঃ আঃ) ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ বংশের বিখ্যাত শাখা আব্দুল উয্‌যা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খোয়াইলিদ বিন আসাদ এবং মাতার নাম ফাতিমা। খোয়াইলিদ ছিলেন মক্কার একজন ধনী ব্যবসায়ী। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিবি খাদিজা অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। তার পোশাক-আশাক ছিল খুবই সাদাসিধে। তাঁর পিতা হাত খরচের জন্য তাঁকে যে টাকা দিতেন তিনি তা থেকে সামান্য নিজের প্রয়োজনে খরচ করে বাকী টাকা গরীব ও এতিমদের দান করতেন। তাঁর সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও পুত-পবিত্রতার সুনাম সবখানে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যার কারণে মক্কার লোকেরা তাঁকে 'তাহিরা' বা পবিত্রা উপাধিতে ভূষিত করে। হযরত খাদিজা যখন মক্কাবাসীর কাছে 'তাহিরা' নামে পরিচিত হন ঠিক তখনই রাসূল (সাঃ) শত্রু-মিত্র সবার কাছে 'আল আমীন বা বিশ্বাসী' উপাধীতে ভূষিত হন। খাদিজার পিতা খোয়াইলিদ মারা যাবার পর তিনি ব্যবসা পরিচালনার জন্য একজন বিশ্বস্ত লোক খুঁজছিলেন। এদিকে মহানবীও চাচা আবু তালিবের সংসারের অভাব অনটনের কারণে আয়-রোজগারের পথ খুঁজছিলেন। এ অবস্থায় হযরত খাদিজা শুনতে পেলেন যে, কোরাইশ বংশের আব্দুল মোতালিবের নাতি ও আব্দুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ (সাঃ) যেমন বিশ্বস্ত তেমনি চরিত্রবান। তিনি মিথ্যা কথা বলেন না, ওয়াদা খেলাফ করেন না, আমানতের খেয়ানত করেন না এবং সবাই তাঁকে আল আমীন বলে ডাকে । তাই একদিন হযরত খাদিজা ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাঁকে সিরিয়ায় পাঠান। ঐ ব্যবসায় প্রচুর লাভ হওয়ার পাশাপাশি মুহাম্মদ (সাঃ) এর যোগ্যতা ও চরিত্র দেখে বিবি খাদিজা মুগ্ধ হন এবং গৃহ পরিচারিকা নাফিসার মাধ্যমে মহানবীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। খাদিজার বিয়ের প্রস্তাব শুনে রাসূল (সাঃ) চাচা আবু তালিবকে তা জানালেন। আবু তালিব খাদিজাকে আগে থেকেই চিনতেন। তাই সব শুনে আবু তালিব হাসিমুখে এ বিয়েতে মত দিলেন। ফলে দু'পক্ষের সম্মতিতে এবং মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে দু'জনের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর হযরত খাদিজা তার সমস্ত ধন সম্পদ ও ব্যবসার দায়দায়িত্ব রাসূলেখোদার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, 'আমার যা কিছু ছিল এ মুহুর্তে সবই আপনার। আপনি যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যয় করতে পারেন। আমি কেবল আপনার সেবিকা হিসাবে থাকতে চাই। ' খাদিজার এ ঘোষণার পর মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু খাদিজার দেওয়া ধনসম্পদ তিনি ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসে ব্যয় করলেন না। সকল ধনসম্পদ তিনি এতিম,মিসকিন, অভাবী ও অনাথদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। এভাবে ধন-সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার পরও তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত মধুর। বিয়ের ১৪ বছর পর রাসূল (সাঃ) যখন মানুষের মুক্তির জন্য হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করা শুরু করলেন তখন খাদিজার বয়স ছিল ৫৫ বছর। এ বয়সেও তিনি হেরা পর্বতের গুহায় গিয়ে প্রিয় স্বামীকে খাবার দিয়ে আসতেন। নবীজির উপর ওহী নাজিল হওয়ার পর তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সব ধরণের জুলুম নির্যাতন, ভয়-ভীতি মোকাবেলায় তিনি রাসূলকে আগলে রাখতেন। ইবাদাত বন্দেগী ও রাসূলের খেদমতে তিনি এতই অগ্রসর হয়েছিলেন যে, আল্লাহতায়ালা স্ময়ং জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে তাকে সালাম দিয়েছেন। অন্যদিকে রাসূল (সা) বলেছেন, দুনিয়ার সমস্ত নারীর উপর চারজন নারীর মর্যাদা রয়েছে। তারা হলেন, মারইয়াম বিনতে ইমান, ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া, হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ ও ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ । রাসূল (সাঃ) মেরাজে গিয়ে বেহেশতের মধ্যে কারুকার্যখচিত একটি বিরাট অট্রালিকা দেখতে পান। ঐ প্রাসাদটির দিকে ইঙ্হিত করে জিবরাইল (আঃ) মহানবীকে জানান, হে আল্লাহর হাবীব! এই প্রাসাদটি আপনার প্রিয়তম স্ত্রী হযরত খাদিজার জন্য তৈরী করা হয়েছে। পরকালে এখানেই তিনি বসবাস করবেন। জিবরাইলের কথা শুনে আল্লাহর নবী খুব খুশী হলেন। ইসলামের এই মহীয়সী নারী ৬১৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ই রমজান ৬৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে রাসূল (সাঃ) প্রচণ্ড ব্যথা পান। পরবর্তীতে খাদিজার কথা মনে করে তিনি বলতেন, আল্লাহপাক খাদিজার চেয়ে উত্তম কোন স্ত্রী আমাকে দেন নি। কারণ যেদিন সে আমার উপর ঈমান এনেছিল সেদিন অন্যরা আমাকে অস্বীকার করেছিল। যখন সে তাঁর সমস্ত ধন-সম্পদ আমাকে উপহার দিয়েছিল, তখন অন্যরা আমাকে বঞ্চিত করেছিল। উম্মুল মোমেনীন হযরত খাদিজার আত্মত্যাগ, দানশীলতা, ইবাদত-বন্দেগী ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত। সুত্রঃ রেডিও তেহরান।